আম পারব। আমি অনেকবার অনছি।
হাবলুমিয়া দুই হাত (ডান হাতের উপর বাম হাত রেখে) মুঠির মতো করল। চোখ বন্ধ করল। সামান্য ঝাকি দিয়ে মুঠি খুলল— আমি সেখানে আছে। সে আমার হাতে আম দিতে দিতে বলল, খেয়ে দেখেন স্যার মিষ্টি আছে কি-না। মধুর মতো মিষ্টি হওয়ার কথা। মাঝে মাঝে টকও হয়। একবার একটা আমি আসছে- ‘কাক দেশান্তরী আমি। এমন টক যে কাক খাইলে দেশান্তরী হবে। স্যার, আমার খেলা দেখে খুশি হয়েছেন?
খুশি হয়েছি। এটা কি কোনো খেলা?
স্যার দুনিয়াটাই তো খেলা। বিরাট খেলা ৷ ক্রিকেট খেলা। কেউ সেঞ্চুরি করতেছে, কেউ আমার মতো শূন্য পায়া আউট। আবার কেউ কেউ আছে বেটিং করার সুযোগ পায় না। না খেইলাই আউট।
ফালগুলি আসে কীভাবে?
স্যার বললাম না খেলা! খেলার মাধ্যমে আসে।
খেলছে। কে?
সেটা তো স্যার বলতে পারব না। জ্ঞান-বুদ্ধি নাই। ক্লাস ফাইভ পাস করার শখ ছিল। পারলাম না। স্যার, ঘরে কি ছুরি আছে?
ছুরি দিয়ে কি করবেঃ
আমট কাঁইট্যা একটা ছোট্ট পিস খায়া দেখতাম। মিষ্টি কি-না। যদিও মন বলতেছে মিষ্টি। তয় মনের কথা বনে ষায়।
আমি ছুরি আনলাম। এক পিস হাবলু মিয়া খেল। এক পিস। আমি খেলাম।
আম মিষ্টি। কড়া মিষ্টি।
হাবলু আনন্দিত গলায় বলল, ইজ্জত রক্ষা হইছে। আমি মিষ্টি। টক হইলে আপনের কাছে বেইজ্জত হইতাম। স্যার, ইজাজত দেন, উঠি?
আরেকবার আসতে পারবেন?
কেন পারব না। যেদিন বলবেন সেদিন আসব। শুক্রবারটা বাদ দিয়া। ঐ দিন জুতা চুরি করি। স্যার কিছু খরচ দিবেন। খেলা দেখাইলাম। এই জন্যে খরচ।
তোমার এই খেলা দেখিয়ে তুমি টাকা নাও?
জে নেই। আমার কোনো দাবি নাই। যে যা দেয় নেই।
সবচেয়ে বেশি কত পেয়েছে?
পাঁচশ’ একবার পাইছিলাম। স্যারের নাম ভুইল্যা গেছি। মুসুল্ল মানুষ। নুরানী চেহারা। সেই মুরুবি ভাবছে আমি জ্বিনের মাধ্যমে আনি। আমি স্বীকার পাইছি। তার ভাবনা সে ভাববে। আমার কী?
মুরুব্বি বলল, হাবলু মিয়া তোমার কি জ্বিন আছে?
আমি বললাম, জ্বে স্যার আপনের দোয়ায় আছে।
মুরুব্বি বলল, জ্বিন কয়টা।
আমি বললাম, দুইটা। একটা মাদি আরেকটা মর্দা। মর্দটার নাম জাহেল। ফল-ফুরুট সেই আনে।
মুরুবি আমার কথা সবই বিশ্বাস পাইছে। আমারে বখশিশ দিছে পাঁচশ’ টেকা।
আমি বললাম, তুমি জ্বিনের মাধ্যমে আনো না?
জে না।
কীভাবে আনো?
স্যার আপনারে তো আগে বলেছি। এইটা একটা খেলা।
খেলাটা তোমাকে কে শিখিয়েছে?
নিজে নিজেই শিখছি। কীভাবে শিখলাম সেটা শুনেন। ফার্মগেটের সামনে দিয়ে যাচ্ছি, দেখি এক লোক পিয়ারা বিক্রি করতেছে। হাতে টাকা নাই। টাকা থাকলে কিনতাম। হঠাৎ কী মনে করে হাত মুঠা করলাম। মুঠা খুলে দেখি পিয়ারা। স্যার কিছু খরচ কি দিবেন? যা দিবেন। তাতেই খুশি। পঞ্চাশ একশ’ দুইশ’…।
আমি তাকে এক হাজার টাকা দিলাম। পাঁচশ’ টাকার দু’টা নোট পেয়ে সে হতভম্ব। তাকে বললাম। পরের বুধবারে আসতে। সে বলল, সকাল দশটা বাজার আগেই বান্দা হাজির থাকবে। যদি না থাকি তাইলে মাটি খাই। কব্বরের মাটি খাই।
আমি বললাম, ফল ছাড়া অন্য কিছু আনতে পারো না?
হাবলু বলল, জে না।
চেষ্টা করে দেখেছ?
অনেক চেষ্টা নিয়েছি। লাভ হয় নাই। একবার জর্দার শট হইল। হাতে নাই পয়সা। জর্দাঁ। কিনতে পারি না। জর্দা বিনা পানীও খাইতে পারতেছি না। শরীর কষা হয়ে গেছে। তখন অনেকবার হাত মুঠ করলাম। মনে মনে বললাম, আয় জর্দা আয়। মুঠা খুঁইল্যা দেখি কিছু না। সব ফক্কা।
মিসির আলি থামলেন। আমি বললাম, ঐ লোক উপস্থিত থাকলে ভালো হতো। হাত মুঠি করত। বাগানের ফ্রেশ চা চলে আসত। চা খাওয়া যেত। এমন জমাটি গল্প চা ছাড়া চলে না। ঘরে ফ্লাস্ক আছে? ফ্লাস্ক দিন আমি দোকান থেকে চা নিয়ে আসছি।
মিসির আলি বললেন, চা আনতে হবে না। চা চলে আসবে।
আমি বললাম, শূন্য থেকে আবির্ভূত হবে? হাবলু মিয়ার মতো?
মিসির আলি বললেন, না। চা-সিঙ্গাড়া বাড়িওয়ালা পাঠাবেন। একটা বিশেষ দোকানের সিঙ্গাড়া তার খুবই পছন্দ। প্রায়ই গাদাখানিক কিনে আনেন। আমাকে পাঠান। তাঁকে সিঙ্গারার ঠোঙ্গা নিয়ে এইমাত্র বাসায় ঢুকতে দেখলাম।
মিসির আলির কথা শেষ হবার আগেই একটা কাজের ছেলে ফ্লাস্ক ভর্তি চা এবং ছয়টা সিঙ্গাড়া নিয়ে ঢুকল। সিঙ্গাড়া সাইজে ছোট। অসাধারণ স্বাদ। যে দোকানে এই জিনিস তৈরি হয় তার কোটিপতি হয়ে যাবার কথা।
আমি চা খেতে খেতে বললাম, তারপর? বুধবার ঐ লোক এলো?
না।
কবে এসেছিল?
আর আসেই নি।
বলেন কি?
আমার ধারণা মারা গেছে। পত্রিকায় একটা নিউজ পড়েছিলাম- মুসল্লিদের হাতে জুতাচোরের মৃত্যু। সেই জুতা চোর আমাদের হাবলু মিয়া তাতে সন্দেহ নেই।
আমি বললাম, আপনি তো গল্পের শেষটা জানতে পারলেন না।
না।
গল্প কি এখানেই শেষ?
এখানেই শেষ না। কিছুটা বাকি আছে।
আর বাকি কী থাকবে? গল্পের যে কথক সে-ই মৃত। গল্প কি থাকবে?
মিসির আলি বললেন, আমাটা তো আছে। পাখি চলে গেছে। কিন্তু পাখির পালক তো ফেলে গেছে। আমাটা হলো পাখির পালক।
আমি বললাম, পাখির পালক, অর্থাৎ আমাটা দিয়ে কি করলেন?
মিসির আলি বললেন, একজন ম্যাজিশিয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। আম তৈরিতে হয়তো ম্যাজিকের কিছু গোপন কৌশল আছে যা আমার জানা নেই। আটলান্টিক সিটিতে একবার একটা ম্যাজিক শো দেখেছিলাম। সেখানে ম্যাজিশিয়ান ফুলের টবে একটা আমের আঁটি পুতলেন। রুমাল দিয়ে ঢাকলেন। রুমাল সরালেন, দেখা গেল আম গাছের চারা বের হয়েছে। আবার সেই চারা রুমাল দিয়ে ঢাকলেন। রুমাল সরালেন, দেখা গেল। গাছ ভর্তি আমি। এই ধরনের কোনো কৌশল কি হাবলু মিয়া করেছে?