হাবলু মিয়া আবার দাঁত বের করে হাসিমুখে বলল, জি স্যার।
আজ খেয়েছেন?
জে না। দিনে খাই না। সবকিছুর নিয়ম আছে। গাঁজা খাইতে হয়। সূৰ্য ডোবার পরে। চরস খাইতে হয় দুপুরে।
লেখাপড়া কিছু করেছেন?
ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছি। ক্লাস ফাইভ পাস করার ইচ্ছা ছিল। একদিন হেড স্যার বললেন, তোর আর লেখাপড়া লাগবে না। তুই চলে যা।
চলে যেতে বললেন কেন?
সেটা উনারে জিগাই নাই। শিক্ষক মানুষরে তো আর জিজ্ঞাস করা যায় না। উনাদের কথা মান্য করতে হয়। উনাদের আলাদা মৰ্যাদা।
আপনার পায়ের জুতাজোড়া তো নতুন মনে হচ্ছে।
হাবলু মিয়া আনন্দিত গলায় বলল, চুরির জুতা স্যার। আমি নিজেই চুরি করেছি। কীভাবে চুরি করেছি। শুনলে মজা পাবেন। স্যার বলব?
বলুন।
আমারে স্যার তুমি কইরা বলবেন। আমি অতি নাদান লোক। আপনের নাকের সর্দির যোগ্যও না। তার চেয়েও অধম। জুতাচুরির গল্পটা কি শুরু করব?
শুরু করে।
জুম্মার নামাজ শুরু হইছে। আমি সোবাহান মসজিদের কাছে। রাস্তা বন্ধ কইরা নামাজ। শেষ সারিতে দেখি এক লোক তার সামনে নয়া জুতা রাইখা নামাজ পড়তাছে। আমি তার সামনে থাইকা জুতাজোড়া নিলাম। সে নামাজের মধ্যে ছিল বইলা আমারে কিছু বলতে পারল না। একবার তাকাইলো। আমি ঝাইড়া দৌড় দিলাম। আমার ভাগ্য ভালো জুতাজোড়া ভালো ফিটিং হইছে। চুরির জুতা ফিটিং-এ সমস্যা।
জুতা কি প্রায়ই চুরি করে?
জে। একেকলার একেক মসজিদে যাই। বনানী মসজিদ থেকে একজোড়া স্যান্ডেল চুরি করেছিলাম। বিলাতি জিনিস, দুইশ’ টাকায় বিক্রি করেছি। এখন আফসোস হয়।
আফসোস হয় কেন?
নিজের ব্যবহারের জন্যে রেখে দিতে পারতাম। স্যান্ডেলে আরাম বেশি। একটু পানের ব্যবস্থা কি করা যায় স্যার? জর্দা লাগবে না। জর্দা আমার সঙ্গে আছে। গোপাল জর্দা। গোপাল জর্দা ছাড়া অন্য জর্দা আমার মুখে রুচে না।
দিনে কয়টা করে পান খাও?
তার কি স্যার হিসাব আছে। ভাতের হিসাব থাকে। দৈনিক দুই বার কি তিন বার। পান এবং চা। এই দুইয়ের হিসাব নাই।
পানের ব্যবস্থা করছি, এখন বলো তুমি যে জুতা চুরি করো খারাপ লাগে না।
খারাপ লাগে না। স্যার, মজা পাই। ইন্টাৱেষ্ট পাই। বাইচ থাকতে হইলে ইন্টারেস্ট লাগে। ঠিক বলেছি। স্যার?
হুঁ।
পানের ব্যবস্থা তো স্যার এখনো করেন নাই? অস্থির লাগতেছে।
সে পান ছাড়াই বেশ খানিকটা জর্দা মুখে দিয়ে চিবুতে লাগল।
হাবলু মিয়ার সঙ্গে আমার যোগাযোগের বিষয়টা এখন পরিষ্কার করি। তাকে পাঠিয়েছে আমার এক ছাত্র। হাবলু মিয়ার না-কি অদ্ভুত এক আধ্যাত্মিক ক্ষমতা। যে কোনো ফলের নাম বললেই সে দুই হাত মুঠি বন্ধ করে। মুঠি খুললেই সেই ফল হাতে দেখা যায়। যে মুঠিবদ্ধ করে ফল আনতে পারে সে পানিও আনতে পারে। পানটা সে কেন আনছে না, বুঝলাম না।
আমি আমার ছাত্রের কথায় কোনোই গুরুত্ব দেই নি। সহজ হাতসাফাই বোঝাই যাচ্ছে। যেসব ফলের নাম চট করে মানুষের মাথায় মনে আসে। সেই সব বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে রাখা হয়। যথাসময়ে বের করা হয়।
ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার করে বলি। একজন বুজরুক আমাকে বলল, স্যার যে কোনো একটা ফুলের নাম বলুন। যে ফুলের নামই বলবেন সেই ফুল আমি পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে দেব।
আমি বললাম, দুপুরমণি ফুল। তুমি বের করো।
সে বলল, স্যার পারলাম না। দুপুরমণি ফুলের নামই শুনি নাই। আজ প্রথম শুনলাম।
আমি বললাম, তোমার পাঞ্জাবির পকেটে আছে গোলাপ ফুল। তুমি এই খেলাটা গোলাপ ফুল নিয়েই দেখাও। কারণ দশজন মানুষের মধ্যে সাতজনই বলবে গোলাপ ফুলের কথা।
বুজরুকি মাথা চুলকে বলল, স্যার কথা সত্য বলেছেন। মাটি খাই। তয় স্যার শুধু গোলাপ রাখি না। রজনীগন্ধাও রাখি। আজকাল অনেকেই রজনীগন্ধার কথা বলে।
যাই হোক, আমাদের হাবলু মিয়াকে আমি সেই দলেই ফেলেছি। লোকটার চোখই বলে দিচ্ছে সে মহা্ধূর্ত। অনেককে ধোঁকা দিয়ে এখন সে এসেছে আমার
ঘরে পান ছিল না। দোকান থেকে পান আনিয়ে তাকে দিয়েছি। দুই খিলি পান একসঙ্গে মুখে পুরে সে জড়ানো পলায় বলল, স্যার কি খেতে চান বলেন, এনে দেই। সে হাত মুঠি করল।
আমি বললাম, একটা আখরোট এনে দাও।
হাবলু মিয়া বিক্ষিত গলায় বলল, আখরোট কী জিনিস?
এক ধরনের বাদাম।
জীবনে স্যার নাম শুনি নাই।
আমি বললাম, আমাকে তাহলে খাওয়াতে পারস্থ না?
হাবলু মিয়া বলল, কেন পারব না। স্যার! আপনি খাবেন। আমিও একটু খায়া দেখব। তবে স্বাদ পাব বলে মনে হয় না। পান-জর্দাঁ খায়া জিবরা নষ্ট। যাই খাই ঘাসের মতো লাগে। একবার নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি খাওয়ার শখ হলো। খায়া দেখি সেইটাও ঘাসের মতো। মিষ্টির বংশ নাই। আমার কাছে এখন চিনিও যা, লবণও তা।
কথা শেষ করে হাবলু মিয়া হাতের মুঠি খুলল। তার হাতে দুটা আখরোট। সে বিস্মিত হয়ে আখরোট দেখছে। আমি মোটামুটি হতভম্ব। হাবলু মিয়া বলল, জিনিসটা ভাঙে ক্যামনে? দাঁত দিয়া?
হাবলু মিয়া কামড়াকামড়ি শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আখরোটের শক্ত খোসা ভাঙিল। হাবলু মিয়া বাদাম ভেঙে মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল, কোনো স্বাদ নাই। শুকনা খড়ের মতো।
আমি বললাম, এখন কি অন্য কোনো ফল আনা যাবে?
হাবলু বলল, অবশ্যই। ফলের নাম বলেন। তবে স্যার হাতের মুঠার চেয়ে বড় ফল হইলে পারব না। তরমুজ আনতে পারব না। কলা পারব না।
আমি বললাম, আমি আনতে পারবে? ছোট সাইজের আমি তো আছে।