আমি বললাম, যা লিখেছেন এর অর্থ কী? বয়স ১৩ বুঝতে পারছি। বেলারানী দাসের বয়স তের। বুদ্ধি ৭-এর অর্থ কী?
মিসির আলি বললেন, বুদ্ধি মাপার কিছু পরীক্ষা আছে। IQ টেস্ট। এই টেস্ট আমার কাছে গ্রহণযোগ্য না। আইনষ্টাইনের মতো মানুষ IQ টেষ্টে হাস্যকর নাম্বার পেয়েছিলেন। আমি নিজে এক ধরনের পরীক্ষা করে বুদ্ধির নাম্বার দেই। সেই নাম্বারে সর্বনিম্ন হলো এক সর্বোচ্চ দশ। আমার হিসেবে বেলারানীর বুদ্ধি ছিল সাত।
আমি বললাম, আপনার হিসেবে আমার বুদ্ধি কত?
মিসির আলি হাসতে হাসতে বললেন, ছায়ের কাছাকাছি। তবে এতে আপসেট হবেন না। মানুষের গড় বুদ্ধি পাঁচ। তা ছাড়া আপনি লেখক মানুষ। ক্রিয়েটিভ মানুষদের সাধারণ বুদ্ধি কম থাকে।
আমি বললাম, আমার বুদ্ধি কম এটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। বটগাছ ১০০এর অর্থ কী?
একটা বটগাছের কথা বলেছি। যার আনুমানিক বয়স ধরেছি ১০০ বছর।
বজ্ৰপাত ২ মানে?
বটগাছে দু’বার বজ্ৰপাত হয়েছিল। শেষ বজ্রপাতে বটগাছটা মারা যায়।
BRD বটগাছ Union-টা ব্যাখ্যা করুন।
বেলারানীর বাবা-মা তাদের মেয়েটাকে একটা বটগাছের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। হিন্দুদের কিছুবিচিত্র আচার আছে! গাছের সঙ্গে বিয়ে তার একটা। এখন যদিও এই প্রথা নেই। তারপরেও বেলারানীর বাবা-মা কাজটা করেছিলেন।
কপার অক্সাইড কী?
কপার ধাতুর সঙ্গে অক্সিজেনের যৌগ- CuO.
গল্পটা বলুন।
না।
না কেন?
কিছু কিছু গল্প আছে বলতে ইচ্ছা করে না। এটা সেরকম একটা গল্প। সব গল্প জানানোর জন্যে না।
আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি। এই গল্প আমি কোথাও লিখব না। কাউকে বলবও না।
মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, না।
তার না বলার বিশেষ একটা ভঙ্গি আছে। এই ভঙ্গিতে যখন না বলে ফেলেন। তখন তাকে আর হ্যা বানানো যায় না। আমি হাল ছেড়ে দিলাম।
মিসির আলি বললেন, অমীমাংসিত রহস্য নিয়ে গল্প করা ঠিক না। এতে মানুষ Confused হয়ে যায়। ঘটনার উপর নানান আধ্যাত্মিকতা আরোপ করে। চলে আসে ভূত-প্রেত। সাধু-সন্ন্যাসী।
আমি বললাম, ভূত-প্ৰেত বাদ দিলাম, সাধু-সন্ন্যাসীরা তো আছেন। না-কি তাদের অস্তিত্বেও আপনার অবিশ্বাস?
মিসির আলি বললেন, অবিশ্বাস। ধর্ম হলো পরিপূর্ণ বিশ্বাস। আর বিজ্ঞান হলো পরিপূর্ণ অবিশ্বাস। ধর্মের বিশ্বাস শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই থাকে। বিজ্ঞানের অবিশ্বাস কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বদলায়। কিছু কিছু অবিশ্বাস বিশ্বাসে রূপ নেয়।
আপনি তো একজন সাইকোলজিষ্ট, বিজ্ঞানী না।
মিসির আলি বললেন, মানুষ মাত্রই বিজ্ঞানী। অবিশ্বাস করা তার Natureএর অংশ। সে জঙ্গলে হাঁটছে। একটা সাপ দেখল। সে শুরু করল অবিশ্বাস দিয়ে—দড়ি না তো? না-কি সাপ?
আবার সে পথে হাঁটতে হাঁটতে একটা দড়ি দেখল। সে শুরু করল অবিশ্বাস দিয়ে—সাপ না তো? না-কি দড়ি। চা খাবেন?
খাব ৷
ঘরে শুধু চা-পাতা আছে। আর কিছুই নেই। লিকার চা চলবে?
চলবে।
মিসির আলি রান্নাঘরে ঢুকলেন এবং বের হয়ে এসে জানালেন, চা পাতাও নেই। চলুন কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে চা খেয়ে আসি।
আমি বললাম, রেস্টুরেন্টে যেতে ইচ্ছা করছে না। আপনার সঙ্গে নিরিবিলি গল্প করছি এই ভালো।
সময় রাত আটটা। আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। মিসির আলির ঘরের চাল টিনের। চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে ভালো লাগছে। ঢাকা শহরে সেই অর্থে কখনো বৃষ্টির শব্দ কানে আসে না। শহরের কোলাহল বৃষ্টির শব্দ গিলে ফেলে।
মিসির আলি বললেন, হাবলু মিয়ার গল্প শুনবেন?
আমি বললাম, গল্পটা যদি আপনার Unsolved খাতায় থাকে তাহলে শুনব। আপনার মতো মানুষ রহস্যের কাছে ধরা খেয়ে গেছেন ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং।
মিসির আলি বললেন, হাবলু মিয়ার গল্প আমার Unsolved ফাইলে আছে। ৩৮ নম্বর।
সব গল্পের নাম্বার আপনার মনে থাকে?
তা থাকে। ফাইলটা নিয়ে আমি প্রায়ই বসি। রহস্যের কিনারা করা যায় কি না তা নিয়ে ভাবি। এখনো হাল ছাড়ি নি। হাল ধরে বসে আছি। অকূল সমুদ্র। নৌকা কোন দিকে নিয়ে যাব বুঝতে পারছি না।
হাবলু মিয়ার গল্পটা শুরু করুন।
মিসির আলি গল্প শুরু করলেন। সাধারণত দেখা যায় শিক্ষকরা ভালো গল্প বলতে পারেন না। তাদের গল্প ক্লাসের বক্তৃতার মতো শোনায়। যিনি গল্প শোনেন কিছুক্ষণের মধ্যেই তার হাই ওঠে। এক পর্যায়ে শ্রোতা বলেন, ভাই, বাকিটা আরেকদিন শুনব। আজ একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে। এখন না গেলেই না।
মিসির আলি শিক্ষক গল্পকথকের দলে পড়েন না। তাঁর বর্ণনা সুন্দর। গল্পের কোন জায়গায় কিছুক্ষণ থামতে হবে তা জানেন। পরিবেশ এবং চরিত্র বর্ণনা নিখুঁত। আমার প্রায়ই মনে হয় মিসির আলির মুখের গল্প CD আকারে বাজারে ছেড়ে দিলে ভালো বাজার পাওয়া যাবে। যাই হোক, তার জবানীতে গল্পটা বলার চেষ্টা করি।
হাবলু মিয়ার বয়স কত বলতে পারছি না। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসিমুখে বলল, জানি না। স্যার। বাপ-মা কিছু বইলা যায় নাই। মুরুকু পিতামাতা। এইসব জানেও না। আপনে একটা অনুমান কইরা নেন।
আমি অনুমান করতে পারলাম না। কিছু মানুষ আছে যাদের বয়স বোঝা যায়। না। হাবলু মিয়া সেই দলের। তার বয়স পঁচিশ হতে পারে, আবার চল্লিশও হতে পারে। অতি রুগ্ন মানুষ। খিকখিক কাশি লেগেই আছে। গায়ের রঙ এক সময় ফর্সা ছিল। রোদে ঘুরে রঙ জুলে গেছে। মাথা সম্পূর্ণ কামানো। গায়ে কড়া নীল রঙের পাঞ্জাবি। পরনের লুঙ্গির রঙ এক সময় খুব সম্ভবত সাদা ছিল! ময়লার আস্তর পড়ে এখন ছাইবৰ্ণ। পায়ে চামড়ার জুতা। জুতাজোড়া নতুন। চকচক করছে। লোকটার গা থেকে বিকট গন্ধ আসছে। আমি বললাম, গাঁজা খাবার অভ্যাস আছে?