আমি বললাম, এই গল্পটা থাকুক মা। তুমি কাঁদতে শুরু করেছ। আমি কান্না সহ্য করতে পারি না।
ইথেন চোখ মুছতে মুছতে বলল, গল্পটা তো শেষ হয়ে গেছে। আর নাই। আপনি আমাকে মা ডেকে কথা শুরু করেছেন তো, এইজন্যে আমি জানি আপনি আমার আপনজন। চাচা ম্যাজিক দেখবেন?
তুমি ম্যাজিক জানো না-কি?
অনেক ম্যাজিক জানি। দড়ি কেটে জোড়া দেবার ম্যাজিক। কয়েন অদৃশ্য করার ম্যাজিক, অংকের ম্যাজিক।
কার কাছে শিখেছ?
বই পড়ে শিখেছি। আমার জন্মদিনে বাবা আমাকে একটা বই দিয়েছেন। বই-এর নাম- ছোটদের ম্যাজিক শিক্ষা। সেখান থেকে শিখেছি। আমি ঠিক করেছি। বড় হয়ে আমি জুয়েল আইচ আংকেলের কাছে ম্যাজিক শিখব। আচ্ছা! চাচা উনি কি আমাকে শেখাবেন?
শিখানোর তো কথা। আমি যতদূর জানি উনি খুব ভালো মানুষ।
ইথেন আয়োজন করে ম্যাজিক দেখাল। দড়ি কাঁটার ম্যাজিকে প্রথমবার কি যেন একটা ভুল করল। কাটা দড়ি জোড়া লাগল না। দ্বিতীয়বারে লাগল। আমি বললাম, এত সুন্দর ম্যাজিক আমি আমার জীবনে কম দেখেছি মা।
সত্যি বলছেন চাচা?
আমি বললাম, অবশ্যই সত্যি বলছি। ম্যাজিক দেখানোর সময় ম্যাজিশিয়ানের মুখ হাসি হাসি থাকলেও তাদের চোখে কুটিলতা থাকে। দর্শকদের তারা প্রতারিত করছে এই কারণে কুটিলতা। ম্যাজিকের বিস্ময়টাও তাদের কাছে থাকে না। কারণ কৌশলটা তারা জানে। তোমার চোখে কুটিলতা ছিল না। ছিল আনন্দ এবং বিস্ময় বোধ।
জামাল সাহেব বাজার নিয়ে ফিরলেন। আমাকে তাঁর মেয়ের সঙ্গে ঘরোয়া ভঙ্গিতে গল্প করতে দেখে মোটেই অবাক হলেন না। যেন আমি তার দীর্ঘদিনের পরিচিত কেউ। ভদ্রলোক স্বল্পভাষী এবং মৃদুভাষী। সারাক্ষণই তাঁর ঠোঁটের কোণায় হাসি লেগে থাকতে দেখলাম। ফোন সারাক্ষণই তার চোখের সামনে আনন্দময় কিছু ঘটছে এবং তিনি আনন্দ পাচ্ছেন।
পাঁচজনকে রুটি খাওয়ানো এবং চা খাওয়ানো প্রসঙ্গে বললেন, খেয়াল আর কিছু না। খেয়ালের বশে মানুষ কত কী করে।
আমি বললাম, পাঁচ সংখ্যাটি কি বিশেষ কিছু?
তিনি বললেন, না রে ভাই। আমি পিথাগোরাস না যে সংখ্যা নিয়ে মাথা ঘামাব। আমি সামান্য কেমিস্ট।
বিদায় নিতে গেলাম, তিনি খপ করে আমার হাত ধরে বললেন, পাগল হয়েছেন! দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে তবে যাবেন। আমার মেয়ের আপনি অতিথি।
আমি বললাম, ঐ ছড়াটা জানেন? আমি আসছি আৎকা। আমারে বলে ভাত খা।
ভদ্রলোক হাসতে হাসতে ভেঙে পড়লেন, যেন এমন মজার ছড়া তিনি তার জীবনে শোনেন নি। তিনি মেয়েকে ডেকে বললেন, ইথেন, তোর চাচু কী বলে শুনে যা! তোর চাচু বলছে- আমি আসছি আৎকা। আমারে বলে ভাত খা। হা হা হা।
আমি পুরোপুরি ঘরের মানুষ হয়ে দুপুরে তাদের সঙ্গে খাবার খেলাম। খাবারের আগে আমাকে টাওয়েল-লুঙ্গি দেয়া হলো। নতুন সাবানের মোড়ক খুলে দেয়া হলো। আমাকে গোসল করতে হলো। আমি দীর্ঘ জীবন পার করেছি। এই দীর্ঘ জীবনে বেশ কয়েকবার নিতান্তই অপরিচিতজনদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছি। ঐ যে গানটা আছে না- আমাকে তুমি অশেষ করেছ, এ কি এ লীলা তব।
খাবার টেবিলে ইথেন বলতে লাগল, বাবা, তুমি চাচুকে মা’র গল্পটা বিলো। কীভাবে তোমাদের বিয়ে হয়েছে সেটা বলে।
জামাল সাহেব বললেন, আরেকদিন বলি মা?
ইথেন বলল, আজই বলতে হবে কারণ চাচু আর আসবে না।
কি করে জানো উনি আর আসবেন না।
ইথেন বলল, আমার মন বলছে। আমার মন যা বলে তাই হয়।
জামাল সাহেব গল্প শুরু করলেন। অস্বস্তি নিয়েই শুরু করলেন। জামাল
সাহেবের জবানিতে গল্পটা এই—
আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। বৃত্তি পরীক্ষা দেব। মন দিয়ে পড়ছি। বৃত্তি পেলে বাবা আমাকে একটা সাইকেল কিনে দেবেন বলেছেন। নতুন সাইকেলের লোভে পড়াশোনা। বৃত্তি পাওয়ার লোভে না।
একদিন অংক করছি, হঠাৎ অংক বইয়ের ভেতর থেকে একটা মেয়ের পাসপোর্ট সাইজ ছবি বের হয়ে এলো। ছয়-সাত বছর বয়েসি মেয়ের ছবি। ছবির পেছনে লেখা জেসমিন। একজন সেই ছবি সত্যায়িত করেছেন। যিনি সত্যায়িত করেছেন তাঁর নাম এস রহমান। জেলা জজ। আমি কিছুতেই ভেবে পেলাম না এই ছবি কোথেকে এলো। আমার অংক বই কে ঘাটাঘাটি করবে? বাবাকে ছবিটা, দেখলাম। বাবা বললেন, কে এই মেয়ে? আশ্চর্ষ তো! আচ্ছা যা খুঁজে বের করছি। এটা কোনো ব্যাপারই না। জেলা জজ রহমান সাহেবের পাত্ত লাগালেই হবে। ছবিটা রেখে দে, চাইলে দিবি।
আমি আমার সুটকেসে ছবিটা রেখে দিলাম। বাবা কখনো ছবি চাইলেন না। বাবার স্বভাবই এ রকম, যে কোনো ঘটনা শুরুতে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নেবেন। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে ঘটনা সব গুরুত্ব হারাবে।
তার প্রায় আড়াই বছর পরের কথা। ঢাকা কলেজে ভর্তি হতে গিয়েছি। ফর্ম, এটেক্টেড ছবি হেড ক্লার্ক সাহেবকে দিলাম। তিনি সবকিছু খুঁটিয়ে দেখে বললেন–দুই কপি ছবি দিতে হবে। তিনি কপি কেন? এটা তো তোমার ছবিও না।
তিনি যে ছবি ফেরত দিলেন, সেটা ঐ জেসমিন মেয়েটার ছবি। তবে আগের ছবিটা না। অন্য ছবি। এতই সুন্দর ছবি যে একবার তাকালে চোখ ফেরানো অসম্ভব ব্যাপার।
আমি জেসমিনের তৃতীয় ছবিটা পেলাম তার দুই বছর পর। রিকশা থেকে নামার পর রিকশাওয়ালাকে মানিব্যাগ বের করে ভাড়া দিচ্ছি। রিকশাওয়ালা বলল, স্যার মানিব্যাগ থাইকা কী যেন নিচে পড়ছে।
তাকিয়ে দেখি একটা ছবি। জেসমিন নামের মেয়েটির ছবি। মেয়েটা এখন তরুণী। সৌন্দর্যে-লাবণ্যে ঝলমল করছে।