মিসির আলি বললেন, শুধু যে দেখেছি তা না। হামা-ভূতকে পাউরুটি খাইয়েছি।
ভূত পাউরুটি খায়?
অন্য ভূত খায় কি-না জানি না, হামা-ভূত খায় এবং বেশ আগ্রহ করেই খায়। গল্প শুনতে চান?
অবশ্যই চাই।
হামা-ভূতের গল্পটা হলো প্রস্তাবনা। তবলার টুকটাক। মূল গল্প অসাধারণ, আমার Unsolved ক্যাটাগরির। হামা-ভূত না দেখলে মূল গল্পের সন্ধান পেতাম না। যাই হোক শুরু করি—
পত্রিকায় পড়লাম নেত্রকোনার সান্ধিকোনা অঞ্চলে হামা-ভূতের উপদ্ৰব হয়েছে। যারা এই ভূত দেখেছে তারা সবাই অসুস্থ হয়ে সদর হাসপাতালে আছে। অঞ্চলের লোকজন সন্ধ্যার পর ঘর থেকে কেউ বের হয় না। হামা-ভূতের বিশেষত্ব হচ্ছে- সে মুহুর্তের মধ্যে অদৃশ্য হতে পারে। হামাগুড়ি দিয়ে গাছে ওঠে। যেসব বাড়িতে নবজাতক শিশু আছে সেই সব বাড়ির চারপাশে বেশি ঘোরাঘুরি করে।
আমার তখন বয়স কম, আদিভৌতিক বিষয়ে খুব আগ্ৰহ। হামা-ভূত দেখার জন্যে ঢাকা থেকে রওনা হলাম। বাংলাদেশের গ্রামে অজানা জন্তুর আক্রমণের খবর প্রায়ই পাওয়া যায়। ভূতের আক্রমণের খবর তেমনভাবে আসে না।
সান্ধিকোনা গ্রামে সন্ধ্যার আগে আগে পৌঁছলাম। প্রত্যন্ত অঞ্চলের নির্ভেজাল গ্রাম। একটা স্কুল আছে, ক্লাস টু পর্যন্ত পড়ানো হয়। স্কুলের দু’জন শিক্ষক ছিলেন, বেতন না পেয়ে একজন চলে গেছেন। যিনি টিকে আছেন তার নাম প্ৰকাশ ভট্টাচাৰ্য।
আমি হামা-ভূত দেখতে এসেছি। এই খবর রুটে গেল। দলে দলে লোকজন আমাকে দেখতে এলো। যেন আমি ফিলোর কোনো বড় তারকা, পথ ভুলে এখানে চলে এসেছি।
প্রত্যন্ত গ্রামের প্রধান সমস্যা একই ধরনের প্রশ্নের জবাব বারবার দিতে হয়।
আপনার নাম?
দেশের বাড়ি?
সার্ভিস করেন?
বেতন কত পান?
শাদি করেছেন?
নতুন যেই আসছে সে-ই এসব প্রশ্ন করছে। রাত কোথায় কটাব এই নিয়ে আলাপ-আলোচনা নিচু গলায় চলতে লাগল। সাধারণত গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ মানুষের বাড়িতে বিদেশি মেহমান রাখা হয়। সম্ভবত এই গ্রামে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নাই। আক্কাস আলি নামের একজনের কথা কয়েকবার শোনা গেল। তবে তার বাড়িতে আজ অসুবিধা। শ্বশুরবাড়ির অনেক মেহমান হঠাৎ করে চলে এসেছে। সুরুজ মিয়ার নাম উচ্চারিত হলো। তাঁর বাড়িতেও সমস্যা। তার ছোটমেয়ের প্রসব বেদনা উঠেছে।
আমি বললাম, আমার রাতে থাকা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি সঙ্গে করে সিপিং ব্যাগ নিয়ে এসেছি। গাছতলায় থাকব।
গাছতলায় থাকবেন! কি কন? গ্রামের ইজ্জত আছে না। আপনি বিদেশি মেহমান।
আমি বললাম, ভাই ভূত দেখতে এসেছি। রাতে যদি কোনো বাড়িতে ঘুমিয়েই থাকি ভূতটা দেখব কি ভাবে? সারারাত আমি জেগেই থাকিব, হাঁটাহাঁটি করব।
গ্রামের এক মুরব্বি বললেন, সাথে কি তিন-চাইরজন জোয়ান পুলাপান দিব? অলঙ্গ নিয়া আপনার সাথে থাকব।
অলঙ্গা জিনিসটা কি?
ব্ররশা। তালগাছ দিয়া বানায়।
আমি বললাম, একগাদা লোক সঙ্গে নিয়ে ঘুরলে তো ভূত দেখা দিবে না। বর্শা দিয়ে ভূত গাথাও যাবে না। আমাকে একই ঘুরতে হবে। আর আমার রাতের খাবার নিয়েও চিন্তা করবেন না। আমি রাতের খাবার, পানি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি।
মুরুব্বি বললেন, এইটা কেমন কথা! চাইরটা ডাল-ভাত আমাদের সাথে খাবেন না?
আমি বললাম, আবার যদি কোনোদিন আসি তখন খাব।
আমার কাছে মনে হলো মুরুব্বি এবং মুরুব্বির সঙ্গে অন্যরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
প্ৰশান্ত ভট্টাচাৰ্য বললেন, কোনো কারণে ভয় পেলে আমার বাড়িতে উঠবেন। ঐ যে টিনের বাড়ি। আমি বলতে গেলে সারারাত জগন্নাই থাকি। রাতে ঘুম হয় না।
ভূতের ভয়ে ঘুম হয় না?
তা না। এমিতেই ঘুম হয় না। ভগবানের নাম জপে রাত পার করি। অনেক আগে থেকেই করি।
গ্রামের লোকজন হামা-ভূতকে যথেষ্টই ভয় পেয়েছে বুঝা যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর যে যার বাড়িতে ঢুকে পড়ল। গল্প-উপন্যাসে শাশানপুরীর উল্লেখ থাকে। সান্ধিকোেনা শশানপুরী হয়ে গেল। আমি একা একা ঘুরছি। চমৎকার লাগছে!
ভাদ্র মাস। এই সময়ে যতটা গরম হবার কথা ছিল তত গরম না। ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। মেঘমুক্ত আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ উঠেছে। মোটামুটি পরিষ্কারভাবেই চারপাশ দেখা যাচ্ছে।
গ্রামের একটাই পুকুর। ভাঙ্গা পাকা ঘাট। পুকুরের চারপাশে গাছপালায় ঢাকা। একদিকে কালিমন্দির আছে। এই অঞ্চলে গ্রামের পটভূমিতে সিনেমা বানালে পুকুরঘাট অবশ্যই ব্যবহার করা হতো।
বিশাল অশ্বথ গাছ দেখলাম। অশ্বখ গাছের নিচে জমাট অন্ধকার। কিছুক্ষণ গাছের নিচে দাঁড়ালাম। গ্ৰামদেশে ভাদ্র মাসে বেশ কিছু মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে গর্তের ভেতর থেকে সাপ বের হয়ে আসে। ভাদ্রআশ্বিন দু’মাস বেশিরভাগ প্রাণীর মেটিং সিজন। সাপেরও তাই। এই সময়ে সাপ মানুষকে আশেপাশে দেখতে পছন্দ করে না।
আমার পায়ে রাবারের গাম বুট। সাপের ভয় এই কারণে পাচ্ছি না। জনমানবশূন্য গ্রাম দেখতে ভালো লাগছে।
অশ্বখ গাছের ডালে প্রচুর হরিয়াল বাসা বেঁধেছে। তাদের ডানার ঝটপট শব্দ শুনতে শুনতেই আমি হামা-ভূত দেখলাম। দেখতে মানুষের মতো। হামাগুড়ি দিয়ে আমার কাছে আসতে আসতে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল।
উত্তেজিত স্নায়ু ঠাণ্ড করাঝার জন্যে আমি সিগারেট ধরলাম। অদৃশ্য হামাভূত আবার দৃশ্যমান হলো এবং আমার দিকে মুখ করে বসল। কাঁধের ঝোলা থেকে এক পিস পাউরুটি বের করে দিলাম। সে পাউরুটিটা আগ্রহ করে খেল।