অ্যানি বিড়বিড় করে বলল, আমি শুধু কিচেনেই ঢুকেছি। অন্য কোথাও না। বিশ্বাস করো।
আমি বললাম, তুমি ভাবিছ কিচেনে ঢুকেছি। চূড়ান্ত পর্যায়ে অবসেশনে এমন ঘটনা ঘটে।
স্যারি।
আমি বললাম, স্যারি বলার কিছু নেই। তোমাকে সোনার মাছির ব্যাপারটা ভুলে যেতে হবে। পারবে না?
তুমি বললে পারব।
একজন সেনসেবল মানুষ যা করে আমি তাই করলাম, অ্যানির সোনার মাছি লুকিয়ে ফেললাম। অ্যানি তা নিয়ে খুব যে অস্থির হলো তা-না। কারণ তখন তার জীবনে মহাবিপৰ্যয় নেমে এসেছে। তার ঈমাক ক্যানসার ধরা পড়েছে। তাকে ভর্তি করা হয়েছে সেইন্ট লুক হাসপাতালে। ডাক্তার তৃতীয় দফা অপারেশন করেছেন। রেডিও থেরাপি শুরু হয়েছে।
পরীর চেয়েও রূপবতী একটি মেয়ে আমার চোখের সামনে প্রেতের মতো হয়ে গেল। মাথার সব চুল পড়ে গেল। শরীর শুকিয়ে নয়-দশ বছর বয়েসি একটা শিশুর মতো হয়ে গেল। শুধু চোখ দুটা ঠিক রইল। পৃথিবীর সব মায়া, সব সৌন্দর্য জমা হলো দুটা চোখে। একদিন ডাক্তার বললেন, স্যারি প্রফেসর। রেডিও থেরাপি আপনার স্ত্রীর ক্ষেত্রে কাজ করছে না।
আমি বললাম, আর কিছুই কি করার নেই?
ডাক্তার চুপ করে রইলেন।
এক রাতের কথা। আমি অ্যানির পাশে বসেছি। অ্যানি বলল, অন্যদিকে তাকিয়ে বসো। আমার দিকে তাকিও না। আমি দেখতে পশুর মতো হয়ে গেছি। একটা নোংরা পশুর দিকে তাকিয়ে থাকার কিছু নেই। তুমি যখন জ্ঞানের কথা বলতে আমি খুব বিরক্ত হতাম, আজ একটা জ্ঞানের কথা বলো।
আমি বললাম, বিজ্ঞান বলছে মহাবিশ্বের entropy বাড়ছে। তাই নিয়ম। বাড়তে বাড়তে entropy তার শেষ সীমায় পৌছবে। পুরো universer-এর মৃত্যু হবে। তোমার জন্যে আমার ভালোবাসা সেদিনও থাকবে। তুমি নোংরা পশু হয়ে যাও কিংবা সরীসৃপ হয়ে যাও তাতে কিছু যায় আসে না।
অ্যানি আমার হাতে মাথা রেখে অনেকক্ষণ কান্দল। তারপর বলল, কিছুক্ষণের জন্যে আমার সোনার মাছিটাকে কি আমার কাছে দেবে? আমি একটু আদর করে তোমার কাছে ফেরত দেব। কোনোদিন চাইব না। প্রমিজ।
আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। কারণ এম্বার খণ্ডটা আমার কাছে নেই। নিতান্তই মূর্থের মতো আমি ফেলে দিয়েছিলাম হাডসন নদীতে। আমি নিশ্চিত জানতাম ঘরে কোথাও লুকিয়ে রাখলে অ্যানি কোনো না কোনোভাবে খুঁজে বের করবে। তার অবসেশন সে শেষ সীমায় নিয়ে যাবে। এখন আমি কী করি? মৃত্যুপথযাত্রীকে কী বলব?
আমি কিছুই বললাম না। মাথা নিচু করে বাসায় ফিরলাম। তার একদিন পর হাসপাতাল থেকে টেলিফোন এলো। অ্যানির অবস্থা ভালো না। তুমি চলে এসো। সে তোমাকে খুব চাইছে।
আমি হাসপাতালে ছুটে গেলাম। অ্যানিকে দেখে চমকালাম। হঠাৎ করে তাকে সুন্দর লাগছে। গালের চামড়ায় গোলাপি আভা। চোখের মণি পুরনো দিনের মতো বকাঝকা করছে।
আমাকে দেখে সে কিশোরীদের মিষ্টি গলায় বলল, থ্যাংক য়ু।
আমি বললাম, থ্যাংকস কেন? অ্যানি বলল, আমি যখন ঘুমুচ্ছিলাম তখন তুমি আমাকে না জাগিয়ে সোনার মাছিটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছ। এইজন্যে ধন্যবাদ।
সে গায়ের চাদর সরাল, আমি স্তম্ভিত হয়ে দেখি এম্বারের টুকরাটা তার হাতে।
প্রফেসর কথা বন্ধ করে চুরুট ধরালেন। চুরুটে টান দিয়ে আনাড়ি স্মেয়কারদের মতো কিছুক্ষণ কাশলেন। তারপর ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললেন, এম্বারের টুকরাটা অ্যানির হাতে কীভাবে এসেছে আমি জানি না। জানতে চাইও না। সব রহস্যের সমাধান হওয়ার প্রয়োজনও দেখছি না। রহস্য হচ্ছে গোপন ভালোবাসার মতো। যা থাকবে গোপনে।
মিসির আলি বললেন, স্যার, এম্বারের টুকরাটা কি এখন আপনার কাছে আছে?
প্রফেসর বললেন, না। অ্যানির কফিনের সঙ্গে দিয়ে দিয়েছি। অ্যানি তার সোনার মাছি সঙ্গে নিয়ে গেছে।
অ্যানির ছবি দেখবে? দেয়ালে তাকাও। বাসকেট বল হাতে নিয়ে হাসছে। ছবিটা আমার তোলা। ছবিটা প্রায়ই দেখি এবং অবাক হয়ে ভাবি, আমাদের সবার বয়স বাড়বে। আমরা জরাগ্রস্ত হব। কিন্তু ছবির এই মেয়েটি তার যৌবন নিয়ে স্থির হয়ে থাকবে। জরা তাকে স্পর্শ করতে পারবে না।
প্রফেসর চুরুট হাতে উঠে দাঁড়ালেন। দ্রুত ঘর থেকে বের হলেন। তাঁর চোখে পানি চলে এসেছে। তিনি সেই পানি তাঁর ছাত্রকে দেখাতে চান না।
হামা-ভূত
বাংলাদেশে। কত ধরনের ভূত আছে জানেন?
আমি বললাম, জানি না।
মিসির আলি বললেন, আটত্রিশ ধরনের ভূত আছে- ব্ৰহ্মদৈত্য, পেত্নি, শাকচুন্নি, কন্ধকাটা, মামদো, পানি ভূত, কুয়া ভূত, কুনি ভূত, বুনি ভূত।
কুনি ভূতটা কি রকম?
মিসির আলি বললেন, ঘরের কোনায় থাকে বলে এদের বলে কুনি ভূত। আরেক ধরনের ভূত আছে। এরা কোনো শরীর ধারণ করতে পারে না। শুধুই শব্দ করে। নিশি রাতে মানুষের নাম ধরে ডাকে। আরেক ধরনের ভূত আছে নাম ‘ভুলাইয়া। এরা পথিককে পথ ভুলিয়ে নিয়ে যায়। শেষ সময় বিলের পানিতে ড়ুবিয়ে মারে।
আমি বললাম, ভূত নিয়ে আপনার স্টকে কোনো গল্প আছে?
মিসির আলির ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো গল্প আছে। তিনি নড়েচড়ে বসলেন। সিগারেট ধরালেন।
হামা-ভূতের নাম শুনেছেন?
না তো।
হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটে বলেই এই ভূতের নাম হামা-ভূত। আট-ন বছর বয়েসি বালকের মতো শরীর। চিতা বাঘের মতো গাছে উঠতে পারে। গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। শো শো শব্দ করে। আপনি কখনো হামা-ভূত দেখেছেন?
আমি বললাম, সাধারণ কোনো ভুতই এখনো দেখিনি। হামা-ভূত দেখার তো প্রশ্নই ওঠে না। আপনি দেখেছেন?