আমি বললাম, সোনার মাছিটা দিয়ে কী করবে? লকেটের মতো গলায় ঝুলাবে? মাছির মতো নোংরা একটা পতঙ্গ গলায় ঝুলিয়ে রাখার কোনো মানে হয়!
অ্যানি বলল, জিনিসটা আগে দেখো। তারপর জ্ঞানী জ্ঞানী কথাগুলি বলো। আমি জিনিসটা দেখলাম। এম্বারের একটা খণ্ড। সিগারেটের প্যাকেটের চেয়ে সামান্য বড়। সেখানে সোনালি রঙের একটা মাছি আটকা পড়ে আছে। এম্বারের নিজের রঙও সোনালি। সূর্যের আলো তার গায়ে পড়লে সে ঝলমল করে ওঠে। মাছিটাও চিকমিক করতে থাকে।
অ্যানি মুগ্ধ গলায় বলল, সুন্দর না?
আমি বললাম, জিনিসটা নকল।
অ্যানি আহত গলায় বলল, মাছিটা নকল?
আমি বললাম, মাছি নকল না, এম্বারটা নকল। চায়নিজরা নকল এম্বার তৈরি করে তার ভেতর কীটপতঙ্গ ভরে আসল বলে বোকাটুরিস্টদের কাছে বিক্রি করে। আসল এম্বারের গুরুত্ব তুমি জানো না। আমি জানি। পৃথিবীর প্রাচীন ফসিলগুলির বড় অংশ হলো এম্বারে আটকা পড়া কীটপতঙ্গ। বিজ্ঞানীদের কাছে এম্বার ফসিল অনেক বড় ব্যাপার।
অ্যানি বলল, এম্বার কী?
আমি বললাম, এক ধরনের গাছের কষ। জমাট বেঁধে শক্ত হয়ে যায়। পৃথিবীর প্ৰাচীন সব সভ্যতাতেই এম্বারের গয়নার নিদর্শন পাওয়া গেছে। আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেটকে চীন সমাট এম্বারের তৈরি একটি রথ উপহার দিয়েছিলেন।
অ্যানি বলল, জ্ঞানের কথা রাখে। জিনিসটা সুন্দর কি-না বলো?
আমি বললাম, নকল জিনিস সুন্দর হবেই। এর পেছনে কত ডলার খরচ করেছ?
সেটা বলব না। তুমি রাগ করবে।
অ্যানি এম্বারের টুকরা গালে লাগিয়ে হাসিহাসি মুখে বসে রইল।
মিসির আলি! আমি তোমাকে বলেছি না, আমার স্ত্রী নর্থ আমেরিকার সবচেয়ে রূপবতী মহিলা।
জি স্যার বলেছেন।
ঐ রাতে তাকে দেখে আমার মনে হলো সে শুধু নর্থ আমেরিকার না, এই গ্রহের সবচেয়ে রূপবতী তরুণী। কবি হোমার তাকে দেখলে আরেকটি মহাকাব্য অবশ্যই লিখতেন। আমি কোনো কবি না। আমি সামান্য সাইকোলজিষ্ট। আমি অ্যানির হাত ধরে বললাম, I love you.
অ্যানি বলল, I love my golden fly.
আমি সামান্য চমকালাম। আমেরিকান কালচারে স্বামী I love you বলার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীকেও I love you বলতে হয়। অ্যানি তা বলে নি এটা এমন কোনো বড় ব্যাপার না। তবে সাইকোলজিস্ট হিসেবে বুঝতে পারলাম অ্যানি সোনার মাছির প্রতি গভীর আসক্তির পথে যাচ্ছে। অবসেশন খারাপ জিনিস। অবসেশন মানুষের চিন্তা-চেতনা, জ্ঞান-বুদ্ধি আচ্ছান্ন করে ফেলার ক্ষমতা রাখে। পৃথিবীর সবচেয়ে পাওয়ারফুল ড্রাগের চেয়েও অবসেশন শক্তিশালী।। তুমি একজন সাইকোলজিষ্ট। আমার এই কথা মনে রেখো।
অ্যানির অবসেশন অতি দ্রুত প্ৰকাশিত হলো। আমি ছোট্ট একটা ঘটনা বলে তার অবসেশনের তীব্ৰতা বুঝাব। এক রাতের কথা, আমি অ্যানির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হচ্ছি। হঠাৎ লক্ষ করলাম অ্যানি তার গালে এম্বারের টুকরোটা চেপে ধরে আছে।
আমি অ্যানির হাত থেকে এম্বারটা কেড়ে নিয়ে মেঝেতে ছুড়ে ফেলতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ অ্যানির কাদো কাদো মুখ দেখে নিজেকে সামলালাম। অবসেশন সম্পর্কে ছোট্ট বক্তৃতা দিলাম। সে আমার কোনো কথাই মন দিয়ে শুনছিল না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আমার হাতের এম্বারের টুকরাটার দিকে।
আরেকদিনের কথা। হাইওয়ে দিয়ে যাচ্ছি। অ্যানি অতি বিরক্তিকর একটা কাজ করছে, চলন্ত গাড়িতে চোখের পাতায় পেনসিল দিয়ে রঙ ঘসছে। অনেকবার তাকে বলেছি। এই কাজটা করবে না। কোনো কারণে গাড়ি ব্লেক করতে হলে চোখ আঁকার পেনসিল ঢুকে যাবে চোখের ভেতর। আমার কথায় লাভ হয় নি। চলন্ত গাড়িতে তার চোখ আঁকা না-কি সবচেয়ে ভালো হয়। আমি অ্যানিকে অগ্রাহ্য করে গাড়ি চালাচ্ছি। সে যা করতে চায় কুরুক। হঠাৎ অ্যানির বিকট চিৎকার Holy Cow, আমি দ্রুত ব্লেক কষে গাড়ি রাস্তার একপাশে নিয়ে এলাম।
অ্যানি, কী হয়েছে?
অ্যানি বলল, সোনার মাছিটা আমি সবসময় বাসায় রেখে আসি। যদি হারিয়ে যায় সেই ভয়ে। আজও তাই করেছি। এখন ব্যাগ খুলে দেখি এম্বারটা আমার ব্যাগে। আমি বললাম, তুমি বলতে চোচ্ছ একটা বস্তুর Teleportation হয়েছে। ঘরে অদৃশ্য হয়ে তোমার ব্যাগে আবির্ভূত হয়েছে?
অ্যানি বলল, হুঁ।
আমি বললাম, তোমার ইন্টেলেকচুয়েল লেভেল নিম্নপর্যায়ের। তাই বলে এতটা নিম্ন পর্যায়ের তা আমি ভাবি নি।
অ্যানি বলল, তাহলে এম্বারটা আমার ব্যাগে কীভাবে এসেছে?
তুমি নিজেই এনেছ। এখন ভুলে গেছ। বস্তুটা বিষয়ে তুমি অবসেস্ড্ বলেই ঘটনাটা ঘটেছে।
অ্যানি বলল, হতে পারে। I am sorry.
সে স্যারি বললেও আমি বুঝতে পারছিলাম, অ্যানি আমার যুক্তি গ্ৰহণ করে। নি। সে ধরেই নিয়েছে সোনার মাছি তার আকর্ষণে আপনাআপনি তার ব্যাগে চলে এসেছে।
কিছুদিন পর আবার এই ঘটনা। অ্যানিকে নিয়ে KMart-এ গিয়েছি। কাগজ কিনব, পেপার ক্লিপ কিনিব। হঠাৎ অ্যানি উত্তেজিত ভঙ্গিতে আমার কাছে উপস্থিত। আমি বললাম, কোনো সমস্যা?
অ্যানি বলল, ই, সমস্যা।
কলো কী সমস্যা।
অ্যানি বলল, শুনলে তো তুমি রেগে যাবে।
রাগব না। বিরক্ত হতে পারি। তোমার সেই সোনার মাছি আবার ব্যাগে চলে এসেছে?
অ্যানি নিচু গলায় বলল, হুঁ। আজ আমি নিজের হাতে এম্বারটা ড্রয়ারে রেখে তোমাকে নিয়ে বের হয়েছি। তুমি ঘরে তালা দিয়েছ।
আমি বললাম, ভালো করে মনে করে দেখো। আমি তালা দেবার পরপর তুমি বললে, কিচেনের চুলা বন্ধ করেছ কি-না মনে করতে পারছি না। আমি তালা খুললাম, তুমি ঘরে ঢুকলে। ঘর থেকে বের হবার সময় সোনার মাছি নিয়ে এসেছি।