আমি বললাম, করি নি। কিন্তু আমার এই বিষয়টা সবাই জানে। আপনারটা জানে না।
না জানুক। আমার গাইড প্রফেসর নেসার আলিংটনের কথা দিয়ে শুরু করি। বেঁটেখাটো মানুষ। চমৎকার স্বাস্থ্য। হাসি-খুশি স্বভাব। নেশা হচ্ছে কাঠের অদ্ভুত অদ্ভুত আসবাব বানানো। তিন কোন টেবিল যার এককোেনা ঢালু। টেবিলে রাখলেই গাড়িয়ে পড়ে যায়। ৪৫ ডিগ্রি বাঁকা বুকশেলফ। যার মাথায় খুঁটি বসানো। দূর থেকে দেখলে মনে হয় একটা মানুষ মাথায় হাত দিয়ে শুয়ে আছে। একটা চেয়ার বানিয়েছেন যার দুটা হাতল উল্টোদিকে। আমি একদিন বললাম, এই ধরনের অদ্ভূত ফার্নিচার কেন বানাচ্ছেন স্যার?
তিনি বললেন, মানুষের মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্যে এগুলি বানাই। মানুষের ব্রেইন এমনভাবে তৈরি যে সে কনভেনশনের বাইরে যেতে চায় না। আমার চেষ্টা থাকে মানুষকে কনভেনশনের বাইরে নিয়ে যাওয়া।
আমি বললাম, স্যার চেয়ারে হাতল থাকে হাত রাখার জন্যে। এটা প্রয়োজন। আপনি প্রয়োজনকে বাদ দেবেন। কেন?
স্যার বললেন, তুমি চেয়ারটায় বসো।
আমি বসলাম।
স্যার বললেন, হাত কোথায় রাখবে এই নিয়ে অস্বস্তি বোধ হচ্ছে না?
জি হচ্ছে।
স্যার বললেন, চেয়ারটায় হাতল থাকলে তুমি চেয়ারে বসামাত্র তোমার হাতের অস্তিত্ত্ব তুলে যেতে। এখন ভুলবে না। যতক্ষণ চেয়ারে বসে থাকবে। ততক্ষণই মনে হবে তোমার দুটা হাত আছে।
আমি স্যারের কথা ফেলে দিতে পারলাম না। অদ্ভুত মানুষটার যুক্তি গ্ৰহণ করতে বাধ্য হলাম। তাঁর সঙ্গে অতি দ্রুত আমার সখ্য হলো। কাঠের ওপর র্যাকা ঘসতে ঘসতে তিনি বিচিত্র বিষয়ে গল্প করতেন, আমি মুগ্ধ হয়ে শুন্যতম।
এক ছুটির দিনে তাঁর বাড়িতে গেছি। তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরি থেকে দুটা বই নেয়া দরকার। স্যার কাঠের কাজ বন্ধ করে সুইমিংপুলের পাশের চেয়ারে শুয়ে আছেন। তাঁকে খানিকটা বিষণ্ণ মনে হচ্ছে। আমি বই দুটির কথা বললাম। তার উত্তরে স্যার বললেন, মিসির আলি চলো সুইমিং করি।
আমি দারুণ অস্বস্তিতে পড়লাম। স্যার একা মানুষ। বিশাল বাড়িতে তিনি ছাড়া দ্বিতীয় প্রাণী নেই। সুইমিংপুলে তিনি যখন নামেন সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে নামেন। নগ্ন অধ্যাপকের সঙ্গে সাঁতার কাটা সম্ভব না। আমি বললাম, স্যার আমার শরীরটা ভালো না। আজ পানিতে নামব না।
স্যার কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, নগ্নতা নিয়ে তোমাদের শুচিবায়ুটা আমি ঠিক বুঝতে পারি না। আমার স্ত্রী অ্যানি যখন জীবিত ছিল তখন আমরা দু’জন সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে সীতার কাটতম। আমার জীবনের অল্প কিছু আনন্দময় মুহুর্তের মধ্যে ঐ দৃশ্যটি আছে। এখন আমি একা নগ্ন সীতার কাটি। আমার সঙ্গে সাঁতার কাটে অ্যানির স্মৃতি।
আমি বললাম, স্যার আজ কি ম্যাডামের মৃত্যু দিবস?
তিনি বললেন, তোমার বুদ্ধি ভালো। কীভাবে ধরেছ?
আমি বললাম, ম্যাডামের কোনো কথা কখনো আপনার কাছ থেকে আগে শুনি নি। আজ শুনলাম। আপনি হাসি-খুশি মানুষ, আজ শুরু থেকেই দেখছি আপনি বিষণ্ণ।
স্যার বললেন, মিসির আলি, আমার স্ত্রী ছিল নর্থ আমেরিকার সবচেয়ে রূপবতী মহিলা এবং নর্থ আমেরিকার সবচেয়ে বোকা মহিলা। ঐ বোকা মহিলা আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসত। বোকা বলেই হয়তো বাসত বুদ্ধিমতীরা নিজেকে ভালোবাসে অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারে না। ভালোবাসার ভান করে। তুমি লাইব্রেরি ঘরে গিয়ে বসো। আমি সাঁতার কেটে আসছি। আজ তুমি আমার সঙ্গে লাঞ্চ করবে। পিজার অর্ডার দেয়া আছে। পিজা চলে আসবে। পিজা অ্যানির অতি পছন্দের খাবার। আমার না। তবে আজকের দিনে নিয়ম করে আমি পিজা খাই।
লাঞ্চপর্ব শেষ হয়েছে। আমি স্যারের সঙ্গে লাইব্রেরি ঘরে বসে আছি। প্রয়োজনীয় দুটা বই আমার হাতে। বিদায় নিয়ে চলে আসতে পারি। আজকের এই বিশেষ দিনে বেচারাকে একা ফেলে যেতেও খারাপ লাগছে। কী করব বুঝতে পারছি না।
স্যার বললেন, তোমার কাজ থাকলে চলে যাও। আমাকে কোম্পানি দেবার জন্যে বসে থাকতে হবে না। নিঃসঙ্গতাও সময় বিশেষে গুড কোম্পানি। আর যদি কাজ না থাকে তাহলে বসো। গল্প করি। অ্যানির বোকামির গল্প শুনবে?
স্যার বলুন।
অ্যানির প্রধান শখ ছিল আবর্জনা কেন। তার শপিংয়ের আমি নাম গাৰ্ব্বেজ শপিং। এই বাড়ির বেসমেন্টের বিশাল জায়গা তার কেনা গাৰ্বেজে ভর্তি। সময় করে একদিন দেখো, মজা পাবে। কি নেই। সেখানে? বাচ্চাদের খেলনা, বাসন, কাচের পুতুল, তোয়ালে, সাবান। সাবান এবং তোয়ালের প্রতি তার ছিল। অবসেশন। সাবান দেখলেই কিনবে। মোড়ক খুলে কিছুক্ষণ গন্ধ শুকবে তারপর রেখে দেবে। তোয়ালের ভাজ খুলে কিছুক্ষণ মুখে চেপে রাখবে। তারপর সরিয়ে রাখবে।
অ্যানিকে নিয়ে আমি প্রায়ই দেশের বাইরে ছুটি কাটাতে যেতাম। বিদেশের নদী, পৰ্বত, অরণ্য, সমুদ্র কোনো কিছুই তাকে আকর্ষণ করত না। সে ক্রেডিট কার্ড নিয়ে মহানন্দে দোকানে দোকানে ঘুরত।
সেবার গিয়েছি ইন্দোনেশিয়ার বালিতে। আলাদা কটেজ নিয়েছি। সমুদ্রের পানিতে পা ড়ুবিয়ে বিয়ার খেয়ে সময় কাটাচ্ছি। অ্যানি ঘুরছে দোকানে দোকানে। তার সময় ভালো কাটছে। আমার নিজের সময়ও খারাপ কাটছে না। এক রাতে সে উত্তেজিত গলায় বলল, আজ একটা অদ্ভুত জিনিস কিনেছি, দেখবে?
আমি বললাম, না। তুমি কিনতে থাকো। প্যাকেট করে সব দেশে পাঠাও।
এটা একটু দেখো। একটা সোনার মাছি।