আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, বাবা, আমি যখন সিন্দুকে কান চেপে ধরেছিলাম তখন তুমি শরীর দুলাচ্ছিলে। শরীর দুলানোর জন্য সিন্দুকের চাবি ঠুকাঠুকি হয়ে নূপুরের মতো শব্দ হয়েছে।
বাবা বললেন, হ্যাঁ, ঠিক আছে। তোর বুদ্ধি মাশাল্লাহ খুবই ভালো। আমার মৃত্যুর পর সিন্দুকে কান চেপে ধরবি। যখনই সময় পাবি তখনই ধরবি। নানান ধরনের শব্দ শুনবি। কিশোরী মেয়ে মানুষের গলা, মেয়েমানুষের হাসি। প্রশ্ন করলে মাঝে মাঝে জবাব পাবি। শুধু একটাই কথা, সিন্দুক খুলবি না।
এই ঘটনার এক সপ্তাহ পরে বুধবার রাতে বাবা মারা গেলেন। মৃত্যুর সময় তাঁর মুখে একটাই কথা-সিন্দুকের চাবি। আমার সিন্দুকের চাবি খারাপ জিনিসে নিয়ে গেছে। সর্বনাশ! আমার মহাসর্বনাশ।
তাঁর কোমরের ঘুনসিতে চাবি ছিল না। পুরো বাড়ি তনুতন্ন করে খুঁজেও চাবি পাওয়া গেল না।
বাবার মৃত্যুর পর আমি অর্থই সমুদ্রে পড়লাম। পড়াশুনা বন্ধ হবার উপক্রম হল। তখন আমাদের স্কুলের অঙ্ক স্যার প্রণব বাবু বললেন, তুই আমার বাড়িতে উঠে আয়। এই বাড়ি তালাবদ্ধ থাকুক।
আমি স্যারের বাসায় উঠলাম। স্যারের স্ত্রীর নাম দুৰ্গা। তিনি আমাকে বললেন, তুই আমার ঠাকুরঘরে কখনো ঢুকবি না। পানি বলবি না, বলবি জল। তা হলেই হবে। এখন আয় আমাকে প্ৰণাম কর। পায়ে হাত না দিয়ে প্ৰণাম কর। স্নান করে। এসেছি। ঠাকুরঘরে ঢুকব।
প্রথম দিন মহিলার কথায় আহত হয়েছিলাম। কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝলাম। এই পৃথিবীতে পাঁচজন ভালো মানুষের মধ্যে তিনি একজন। তিনি কখনো বলেন নি আমাকে মা ডাক। কিন্তু আমি তাঁকে মা ডাকতাম। তিনি আমাকে ডাকতেন মিছরি। তাঁর মৃত্যুর পর আমি মুখাগ্নি করি। কারণ তিনি বলে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর মুসলমান বন্দপুলাটা যেন আমার মুখাগ্নি করে।
তাদের পরিবার কঠিন নিরামিষাশী ছিল। আমাকে নিরামিষ খাবার খেতে হত। আমার আমিষ খাবার অভ্যাস যেন নষ্ট না হয়ে যায় এই জন্য মা আমাকে আলাদা হাঁড়িতে মাঝে মধ্যে ডিম রান্না করে দিতেন। আমার মায়ের গল্প আলাদাভাবে আরেকদিন বলব। আমার unsolved খাতায় উনার ছোট্ট একটা অংশ আছে। উনি প্ৰতি অমাবস্যায় অপদেবতাদের ভোগ দিতেন। বাড়ির পেছনের জঙ্গলে একটা শ্যাওড়া গাছের নিচে কলাপাতায় করে গজার মাছ পুড়িয়ে দিতেন। তিনি বলতেন, ভোগ দেবার কিছুক্ষণের মধ্যে একজন অপদেবতা ভোগ গ্রহণ করার জন্য আসতেন। সেই অপদেবতার চোখ নেই। তার শরীরে মাংস পুড়ার গন্ধ। একদিন আমি মার সঙ্গে অপদেবতাকে ভোগ দিতে গিয়েছিলাম। আচ্ছা, এই অংশটা বাদ। আজি বরং সিন্দুকের গল্পটা করি।
আমি স্কুল ছুটির দিনে নিজের বসতবাড়িতে যেতাম। বাড়ি তালাবদ্ধ থাকত। তালা খুলে ঘর ঝাঁট দিতাম। এবং বেশ কিছু সময় সিন্দুকে কান লাগিয়ে বসে থাকতাম। সিন্দুকের ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ আসত না। আসবে না জানতাম, তারপরেও অভ্যাসবশে কান লাগিয়ে থাকা।
একদিনের কথা। সিন্দুকে কান লাগিয়ে বসে আছি। হঠাৎ শুনলাম রিনারিনে মেয়েদের গলায় কেউ একজন বলল, এই এই। আমি আমি আমি। এই এই।
আতঙ্কে আমার শরীর প্রায় জমে গেল। আমি ছিটকে দূরে সরে গেলাম। মনে হচ্ছে সিন্দূকটা সামান্য নড়ছে। কেউ একজন প্রাণপণ চেষ্টা করছে ভেতর থেকে সিন্দুকের ডালা খুলার। কেউ একজন বন্দি হয়ে আছে। বের হবার চেষ্টা করছে। দৌড়ে প্রণব স্যারের বাড়িতে চলে গেলাম। ঘর তালাবদ্ধ করার কথাও মনে হল না। সেদিন এতই ভয় পেয়েছিলাম যে রাতে জ্বর এসে গিয়েছিল। জুরের ঘোরে কানের কাছে সারাক্ষণ কেউ একজন বলছিল, এই এই এই। আমি আমি আমি। এই এই এই।
পরের সপ্তাহ আবার গেলাম। সিন্দুকে কান লাগানো মাত্র শুনলাম—এই এই এই।
আমি বললাম, আপনি কে?
উত্তরে শুনলাম, আমি আমি আমি।
আপনার নাম কী?
আমি আমি আমি।
সিন্দুকের ভেতর কীভাবে ঢুকলেন? উত্তরে সেই পুরোনো শব্দ-‘আমি আমি আমি।’ তবে শব্দ স্পষ্ট।
ইলেকট্রসিটি চলে এসেছে। মিসির আলি ফুঁ দিয়ে বাতি নেভালেন। তাকিয়ে দেখি মিসির আলির কপালে ঘাম। তিনি এখনো গল্পের ভেতরে আছেন। যেন চোখের সামনে সিন্দুক দেখছেন।
আমি বললাম, মিসির আলি সাহেব। ভাই, এটা কি কোনো অডিটরি হেলুসিনেশন হতে পারে?
হ্যাঁ, হতে পারে। সিন্দুক নিয়ে আমার কিশোর মনে প্রবল কৌতুহল থেকে ঘোর তৈরি হতে পারে। তবে ঘোর ছিল না।
কীভাবে বুঝলেন ঘোর ছিল না?
আমি আমার মাকে অর্থাৎ প্রণব স্যারের স্ত্রীকে বাড়িতে এনেছিলাম। তাকে বললাম, সিন্দুকে কান রাখতে। তিনি কিছু শুনেন কি না। তিনি কান রাখলেন এবং অবাক হয়ে বললেন, বাচ্চা একটা মেয়ে বলছে- আমি আমি আমি। ঘটনা কী রে?
আমি বললাম, জানি না।
মা বললেন, এর চাবি কই? চাবি আন সিন্দুক খুলব।
আমি বললাম চাবি নাই। চাবি হারিয়ে গেছে।
মা বললেন, আমার ধারণা সিন্দুকে অনেক ধনরত্ন আছে। ধনরত্ন পাহারা দেবার জন্য বাচ্চা কোনো মেয়েকে সিন্দুকের ভেতর ঢুকিয়ে তালা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মেয়েটাকে যাক করা হয়েছে। আগেকার মানুষের বিশ্বাস ছিল যাক ধনরত্ন পাহারা দেয়। মিস্ত্রি দিয়ে সিন্দুক খোলা দরকার কিন্তু সেটা ঠিক হবে না।
ঠিক হবে না কেন?
চারদিকে জানাজানি হবে। সিন্দুক খুলতে হবে গোপনে।
মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন সিন্দুকের চাবির সন্ধান পাই।