ফ্রি চা খেয়ে বিদায় হয়ে যাবার প্রশ্নই আসে না। জিজ্ঞাসাবাদ করে জানলাম জনৈক ‘প্রবেচার স্যার দোকানিকে প্রতি মাসে শুরুতে ৪৫০ টাকা দেন। যাতে প্ৰতিদিন পাঁচজন কাস্টমারকে সে ফ্রি চা খাওয়াতে পারে। তিন টাকা করে কাপ। দিনে পনেরো টাকা। ত্রিশ দিনে ৪৫০ টাকা।
আমি বললাম, প্রফেসর সাহেবের নাম কী?
নাম জানি না। কুদ্দুস জানে, কুদ্দুসারে জিগান।
কুদ্দুস কে?
রুটি বেচে। সামনের গলির ভিতর ঢুকেন। চার-পাঁচটা বাড়ির পরে কুদ্দুসের ছাপড়া পাইবেন।
কুদ্দুসও কি পাঁচজনকে ফ্রি রুটি খাওয়ায়?
জে। হে লাভ করে মেলা। ডেইলি সত্ত্বর টেকা পায়। এক দুইজনারে ফ্রি খাওয়ায়। বাকি টেকা মাইরা দেয়। প্রবেচার স্যাররে ঘটনা বলেছি। উনি কোনো ব্যবস্থা নেন নাই।
উনি থাকেন কোথায়?
জানি না। কুদ্দুস জানতে পারে। তারে জিগান গিয়া।
আমি কুদ্দুসের সন্ধানে বের হলাম। সে রাস্তার পাশে ছাপড়া ঘর তুলে রুটি, ডাল এবং সবজি বিক্রি করে। শুকনা মরিচের ভর্তা ফ্রি। দেখা গেল। সে প্রফেসার স্যারের নাম ছাড়া অন্য কিছুই জানে না। প্রফেসার স্যারের নাম জামাল। কুদ্দুসকে জামাল স্যারের ওপর অত্যন্ত বিরক্ত মনে হলো। সে বলল, এমন ঝামেলার মধ্যে আছি। দুনিয়ার না খাওয়া মানুষ ভিড় কইরা থাকে ফ্রি খানার জন্য। পাঁচজনের বেশি খাওয়াইতে পারি না। এরা বুঝে না।
আমি বললাম, জামাল সাহেব কোথায় থাকেন জানো?
জানি না।
এই এলাকাতেই কি থাকেন?
বললাম তো জানি না।
উনার বয়স কত? চেহারা কেমন?
রোগা-পাতলা। মাথায় চুল কম। গায়ের রঙ ময়লা। চশমা আছে। বয়স কত বলতে পারব না। এখন যান। ত্যক্ত কইরেন না। ঝামেলায় আছি।
আমার জন্যে জামাল সাহেবকে খুঁজে বের করা কোনো সমস্যা না। বাসার ঠিকানা বের করে এক ছুটির দিনে সকাল এগারোটার দিকে উপস্থিত হলাম। একতলা বাড়ি। সামনে বাগান। বাগানে দেশি ফুলের গাছ। ক্যামিনি, হাসনাহেনা এইসব। বিশাল একটা কেয়া গাছের ঝোপ দেখলাম। বাড়ির সামনে কেউ সাপের ভয়ে কেয়া গাছ লাগায় না। উনি লাগিয়েছেন। বাঁশের একটা গেটের মতো আছে! গোটে বিখ্যাত নীলমণি লতা। বিখ্যাত কারণ নীলমণি লতা নাম রবীন্দ্রনাথের দেয়া। বড় গাছের মধ্যে একটা কদম গাছ এবং একটা বকুল গাছ। অচেনা একটা বিশাল গাছ দেখলাম।
কলিংবেল চাপ দিতেই দশ-এগারো বছরের এক কিশোরী দরজা খুলে দিল। আমি অবাক হয়ে কিশোরীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। অবাক হবার কারণএমন মিষ্টি চেহারা! আমার প্রথমেই জিজ্ঞেস করা উচিত, এটা কি জামাল সাহেবের বাড়ি? তা না করে আমি বললাম, কেমন আছ মা?
মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল, চাচা, আমি ভালো আছি।
এই গাছটার নাম কী?
ছাতিম গাছ। অনেকে বলে ছাতিয়ান।
জামাল সাহেব তোমার কে হন?
বাবা।
উনি বাড়িতে আছেন?
বাজার করতে গেছেন। চাচা, ভেতরে এসে বসুন। বাবা চলে আসবেন।
মা, তোমার নাম কী?
আমার নাম ইথেন। বাবা কেমিস্ট্রির টিচার তো, এইজন্যে আমার নাম। রেখেছেন ইথেন। চাচা, ভেতরে আসুন তো।
আমি ভেতরে ঢুকলাম। বসার ঘরে শীতলপাটি বিছানো। শীতলপাটির ওপর বেতের চেয়ার। দেয়ালে একটাই ছবি। জলরঙে আঁকা ঢাকা শহরে বৃষ্টি। এই একটা ছবিই ঘরটাকে বদলে ফেলেছে। ঘরটায় মিষ্টি স্বপ্ন তৈরি হয়েছে। মনে হচ্ছে। আমি নিজেও এই ঘরের স্বপ্নের অংশ হয়ে গেছি।
ইথেন আমাকে লেবুর শরবত বানিয়ে খাওয়াল এবং মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গল্প করতে লাগল–
আমাদের কাজের মেয়েটার নাম শুনলে আপনি চমকে উঠবেন। নাম বলব চাচা?
বলো।
ওর নাম সুধারানী।
সুধারানী নাম শুনে চমকাব কেন?
কারণ নামটা হিন্দু, কিন্তু সে মুসলমান। সপ্তাহে সে একদিন ছুটি পায়। আজ তাঁর ছুটি। সে ঘরেই আছে, কিন্তু কোনো কাজ করবে না। এক কাপ চ পর্যন্ত নিজে বানিয়ে খাবে না। আমাকে বলবে, ইথু, এক কাপ চা দাও। আমাকে সে ডাকে ইথু।
ছুটির দিনে রান্না কে করে? তোমার বাবা?
হুঁ। আমি বাবাকে সাহায্য করি। বাবা লবণের আন্দাজ করতে পাৱে না। আমি লবণ চেখে দেই। আজ আমি একটা আইটেম রান্না করব।
কোন আইটেম?
আগে বলব না। আপনি খেয়ে তারপর বলবেন কোনটা আমি রোধেছি। আমি বললাম, মা, তুমি আমাকে চেনো না। আজ প্রথম দেখলে। আমি কী জন্যে এসেছি তাও জানো না। আমাকে দুপুরের খাবার দাওয়াত দিয়ে বসে আছ?
হ্যাঁ। কারণটা বলব?
বল।
আমার মা তখন খুবই অসুস্থ। বাবা মা’কে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে এসেছেন। যেন মা’র মৃত্যুর সময় আমি এবং বাবা মা’র দুই পাশে থাকতে পারি। কাঁদতে ইচ্ছা হলে আমি যেন চিৎকার করে কাঁদতে পারি। হাসপাতালে তো চিৎকার করে কাঁদতে পারব না। অন্য রোগীরা বিরক্ত হবে। তাই না চাচা?
হ্যাঁ।
এক রাতে মা’র অবস্থা খুব খারাপ হলো। আমি ঘুমাচ্ছিলাম, বাবা আমাকে ঘুম থেকে তুলে মা’র কাছে নিয়ে গেলেন। মা বললেন, আমার ময়না সোনা চাঁদের কণা ইথেন বাবু কেমন আছ?
আমি বললাম, ভালো আছি মা।
মা বলল, মাগো! আমি তো চলে যাব, মন খারাপ করো না।
আমি বললাম, আচ্ছা।
মা বলল, আমি থাকব না। তুমি তোমার বাবার সঙ্গে থাকবে, বড় হবে। অনেকের সঙ্গে তোমার পরিচয়ও হবে। যেসব পুরুষমানুষ তোমাকে প্রথমেই মা ডেকে কথা শুরু করবে ধরে নিবে এরা ভালো মানুষ। কারণ তুমি খুব রূপবতী হবে। অতি অল্প পুরুষমানুষই অতি রূপবতীদের মা ডাকতে পারে। এই বিষয়টা আমি জানি, কারণ আমিও অতি রূপবতীদের দলের।