সালাম বলল, স্যার আমি উনারে ছোটবোনের মতো দেখেছি। বেতালা কিছু করি নাই।
জানি আপনি বেতালা কিছু করেন নি। কিন্তু কিছু একটা ঘটনা ঘটেছে যাতে মেয়েটা ভয় পেয়েছে। প্রচণ্ড ভয়। ঘটনাটা বলুন।
সালাম বলল, আমার চাকরি নট হবে না তো স্যার? চাকরি নট হইলে না খায়া মরব।
মিসির আলি হাসলেন। সালাম তার হাসি দেখে ভরসা পেল বলে মনে হলো। সে মেঝের দিকে তাকিয়ে কথা বলা শুরু করল।
যে চাকরি আমার রুটি-রুজি তারে খারাপ বলা ঠিক না। আল্লাহপাক নারাজ হন। কিন্তু স্যার চাকরিটা খারাপ। সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত লিফটে উঠা-নমা করি। মাঝখানে আধা ঘণ্টা লাঞ্চের ছুটি। লিফটে থাকি, আমার মনটা থাকে বাইরে।
একদিন লিফটে আমি একা। এগারো তলা থেকে একজন বোতাম টিপেছে। লিফট উঠা শুরু করেছে। আমার মনটা বলতেছে থাকব না। শালার লিফটের ভিতরে। সঙ্গে সঙ্গে দেখি আমি লিফটের বাইরে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে দাঁড়ায়ে আছি। কি যে একটা ভয় পাইলাম স্যার। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল! মনে হইল মাথা খারাপ হয়ে গেছে। লিফটের সামনে দাড়িয়ে আছি, এক সময় আমাকে ছাড়া লিফট নামল। এগারো তালার বড় সাহেব নামলেন। আমাকে দেখো ধমক দিলেন। বললেন, কোথায় ছিলো?
আমি বললাম, টয়লেটে।
স্যার এই হলো শুরু। আমি ইচ্ছা করলেই লিফটের বাইরে আসতে পারি। কীভাবে পারি জানি না। লোকজন থাকলে বাইর হই না। ঐ দিন আফার দমবন্ধ হয়ে আসছিল তখন বাইর হইছি। লিফট উপরে নিয়ে গেছি। আফা অজ্ঞান হয়ে ছিল। ফরহাদ স্যারকে খবর দিলাম। উনি আফরে নিয়া হাসপাতালে গেলেন।
আপনার এই ব্যাপারটা আর কেউ জানে?
আমার ছোটভাই কালামরে শুধু বলেছি। সে বলেছে আমার মাথা খারাপ হইছে। আর কিছু না। লিফটের চাকরি বেশিদিন করলে সবারই মাথা খারাপ হয়। স্যার এই আমার কথা। আর কোনো কথা নাই। আর কিছু জানতে চান?
মিসির আলি বললেন, না। আর কিছু জানতে চাই না।
আমরা দু’জন বাসায় ফিরছি। আমি বললাম, এই ঘটনাটা কি আপনার ‘Unsolved’ খাতায় উঠবে?
মিসির আলি বললেন, হ্যাঁ।
ঘটনাটা কি লিলি মেয়েটিকে জানানোর প্রয়োজন আছে?
মিসির আলি বললেন, না।
সিন্দুক
মিসির আলির ঘর অন্ধকার। তিনি অন্ধকার ঘরে চেয়ারে পা তুলে বসে আছেন। চেয়ারে পা তুলে বসে থাকার বিষয়টা আমার অনুমান। অন্ধকারের কারণে তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না। তবে পা তুলে জবুথবু ভঙ্গিতে বসে থাকা তাঁর অভ্যাস।
আমি বললাম, ঘরে মোমবাতি নাই?
মিসির আলি বললেন, টেবিলে মোমবাতি বসানো আছে। এতক্ষণ জ্বলছিল। আপনি ঘরে ঢোকার কিছুক্ষণ আগে বাতাসে নিভে গেছে।
আমি বললাম, মোমবাতি জ্বালাব? নাকি অন্ধকারে বসে থাকবেন?
মিসির আলি বললেন, থাকি কিছুক্ষণ অন্ধকারে। আঁধারের রূপ দেখি।
বিশেষ কিছু নিয়ে চিন্তা করছিলেন?
মিসির আলি বললেন, আপনার কি ধারণা সারাক্ষণ আমি কিছু-না-কিছু নিয়ে চিন্তা করি? চিন্তার দোকান খুলে বসেছি? পকেটে দিয়াশলাই থাকলে মোমবাতি জ্বালান। একা একা অন্ধকারে বসে থাকা যায়। দুজন অন্ধকারে থাকা যায় না।
কেন?
দুজন হলেই মুখ দেখতে ইচ্ছা করে।
আমি মোম জ্বালালাম। আমার অনুমান ঠিক হয় নি। মিসির আলি পা নামিয়ে বসে আছেন। তাঁকে সুখী সুখী লাগছে। বিয়েবাড়ির খাবার খাওয়ার পর পান মুখে দিয়ে একটা সিগারেট ধরালে চেহারায় যে সুখী সুখী ভাব আসে সেরকম।
মিসির আলি বললেন, বিশেষ কোনো কাজে এসেছেন নাকি গল্পগুজব?
গল্পগুজব।
মিসির আলি বললেন, আপনি কি একটা ব্যাপার লক্ষ করেছেন? আমরা সব সময় বলি গল্পগুজব। শুধু গল্প বলি না। তার অর্থ হচ্ছে আমাদের গল্পে গুজব একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। আমাদের গল্পের একটা অংশ থাকবে গুজব। ইংরেজিতে কিন্তু কেউ বলে না। Story Rumour, কারণ Rumour ওদের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ না।
আমি বললাম, আপনি গল্পই বলুন। গুজব বাদ থাক।
কী গল্প শুনবেন?
যা বলবেন তাই শুনব। আপনার ছেলেবেলার গল্প শুনি। শৈশব-কথা। আপনার বাবা কি আপনার মতো ছিলেন?
আমার মতো মানে?
জটিল চিন্তা করা টাইপ মানুষ।
আমার বাবা নিতান্তই আলাভোলা ধরনের মানুষ ছিলেন। তাঁর প্রিয় শব্দ হল আশ্চৰ্য। কোনো কারণ ছাড়াই তার বিস্মিত হবার ক্ষমতা ছিল। উদাহরণ দেব?
দিন।
একবার একটা প্রজাপতি দেখে কী আশ্চর্য! কী আশ্চৰ্য বলে তার পেছন পেছন জুটলেন। তিনি শুধু যে একা ছুটলেন তা না, আমাকেও ছুটতে বাধ্য করলেন। প্রজাপতির একটা ডানা ছিঁড়ে গিয়েছিল। বেচারা একটা ডানায় ভর করে উড়ছিল।
আমি বললাম, আশ্চৰ্য হবার মতোই তো ঘটনা।
মিসির আলি বললেন, তা বলতে পারেন। তবে দিনের পর দিন এই ঘটনার পেছনে সময় নষ্ট করা কি ঠিক? তাঁর প্রধান কাজ তখন হয়ে দাঁড়াল প্রজাপতি ধরে ধরে একটা ডানা ছিঁড়ে দেখা সে এক ডানায় উড়তে পারে কি না। শুধু প্রজাপতি না, তিনি ফড়িং ধরেও ডানা ছিঁড়ে দেখতেন উড়তে পারে কি না। বাবার এই কাজগুলো আমার একেবারেই পছন্দ হত না। কৌতূহল মেটানোর জন্য তুচ্ছ পতঙ্গকে কষ্ট দেয়ার কোনো মানে হয় না।
আপনার বাবার পেশা কী ছিল?
উনি মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। উলা পাস শিক্ষক। যদিও আমাকে তিনি মাদ্রাসায় পড়তে দেন নি। তিনি লম্বা জুব্বা পরতেন। জুঘার রঙ সবুজ, কারণ নবীজি সবুজ রঙের জুম্বা পরতেন। বাবার ঝোঁক ছিল সত্য কথা বলার দিকে। তাঁর একটাই উপদেশ ছিল, সত্যি বলতে হবে। তাঁকে খুব অল্প বয়সে সত্যি বিষয়ে আটকে ফেলেছিলাম। শুনবেন সেই গল্প?