লিলি সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা শুরু করল। উচ্চারণ স্পষ্ট। বাচনভঙ্গি ভালো। কথা বলার সময় সামান্য মাথা দুলানোর অভ্যাস আছে।
ভালো মেয়ে বলতে আপনারা যা ভাবেন আমি তা-না। আমি খারাপ মেয়ে। যথেষ্ট খারাপ মেয়ে। মতিঝিলের ঐ অফিসে আমি একজন ভদ্রলোকের কাছে যাই। তাঁর নাম ফরহাদ। প্রেম-ভালোবাসা এইসব কিছু না। আমি নিরিবিলি কিছু সময় তার সঙ্গে কাটাই। তার বিনিময়ে টাকা নেই। উপহার দিলে উপহার নেই। আমার যে টাকা-পয়সার অভাব তাও না। বাবা মালয়েশিয়া থেকে ভালো টাকা পাঠান।
আমি শুধু যে ফরহাদ সাহেবের কাছেই যাই তা না, আরো লোকজনদের কাছে যাই। একটা নোংরা মেয়ে তো নোংরা পুরুষদের সঙ্গেই মিশবে। এই দেশে নোংরা পুরুষের কোনো অভাব নেই। বেশিরভাগ নোংরা পুরুষই বিবাহিত। স্ত্রীছেলে-মেয়ে নিয়ে সুখী জীবনযাপন করে। সুযোগ পেলেই আমার মতো নষ্ট মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করে।
একবার এক লোকের সঙ্গে তার স্ত্রী সেজে কক্সবাজারে তিন দিন ছিলাম। মা’কে বলেছি। স্টাডি ট্যুরে যাচ্ছি।
আমি গায়ের চামড়া বিক্রি করলেও নেশা করি না। মদ, সিগারেট, ড্রাগস কিছুই না। পার্টি মাঝে মাঝে মদ খাওয়ার জন্যে খুব ঝুলাবুলি করে। তারা মনে করে নেশাগ্ৰস্ত মেয়ের সঙ্গে শোয়া ইন্টারেষ্টিং। তাদের পীড়াপীড়িতেও রাজি হই না। কক্সবাজারে যে লোকের সঙ্গে গিয়েছিলাম। সে বলেছিল প্রতি পেগী হুইঙ্কি খাবার জন্যে সে আমাকে এক হাজার করে টাকা দেবে। তখন শুধু সাত পেগ খেয়ে সাত হাজার টাকা নিয়েছি। এবং ঐ লোকের গায়ে বমি করেছি। তার শিক্ষা সফর হয়ে গেছে।
মিসির আলি আংকেল, এখন বলুন আমি কেমন মেয়ে?
মিসির আলি কিছু বললেন না। লিলি ঠোঁট বাঁকা করে হাসল। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম মেয়েটা তার চরিত্রের বিকারগ্রস্ত অংশটির কথা বলে আরাম পাচ্ছে।
লিলি বলল, যাই হোক আসল গল্প বলি। আমি ফরহাদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। শুক্রবারে অফিসে একেবারেই লোকজন থাকে না কথাটা ঠিক না, কিছু লোকজন থাকে। কেয়ারটেকার, মালী, ঝাড়ুদার। শুক্রবারে লিফট বন্ধ থাকে। ফরহাদ সাহেব বসেন ছয় তলায়। ছয় তলা পর্যন্ত হেঁটে উঠতে হয়। এই জন্যে শুক্রবারে আমি তার সঙ্গে দেখা করতে চাই না। গতকাল গিয়েছিলাম, কারণ তিনি বলেছেন আমাকে একটা মোবাইল সেট দেবেন। আমার একটা দামি মোবাইল সেট ছিল, আই ফোন। সেটা চুরি হয়ে গেছে।
আমি অফিসে পৌঁছলাম। সকাল এগারোটায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাব, খাকি ড্রেস পরা একজন এসে বলল, আপা আপনি কি ফরহাদ সাহেবের কাছে যাবেন?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
সে বলল, লিফটে করে যান। এত দূর হেঁটে উঠবেন।
লিফট চালু আছে?
সে বলল, আজ চালু আছে। কমার্শিয়াল ব্যাংকে আজ সারাদিন কাজ হবে। তারা খবর দিয়ে একটা লিফট চালু রেখেছেন।
আপনি কি লিফটম্যান
জি আম্পা ৷
আপনি আমাকে চিনেন?
নামে চিনি না। আপনি ফরহাদ সাহেবের কাছে প্রায়ই যান এইটা জানি।
আমি বললাম, ইউনিভার্সিটির কাজে আসতে হয়। বিবিএ করছি তো। ফরহাদ সাহেব কোম্পানি-আইন বিষয়ে আমাকে পড়ান।
আমি লিফটম্যানকে নিয়ে লিফটে উঠলাম। সিক্সথ ফ্লোরে বোতাম চাপা। হয়েছে, লিফট কিন্তু থামল না। সাত-আট পার হয়ে নিয়ের দিকে যাচ্ছে। লিফটম্যান ব্যস্ত হয়ে বোতাম চাপাচাপি করছে। আট এবং নিয়ের মাঝখানে লিফট থেমে গেল। লিফটের ভিতরের বাতি নিভে গেল। মাথার উপরে যে ফ্যান ঘুরছিল সেটা বন্ধ হয়ে গেল। লিফটম্যান বলল, খাইছে আমারে, আবার ধরা খাইলাম।
কারেন্ট চলে গেছে না-কি?
বুঝতেছি না। তয় এই জায়গায় লিফট পেরায়ই আটকায়। একবার আটকাইছিল চাইর ঘন্টার জন্য।
সর্বনাশ।
আফা আপনার কাছে মোবাইল আছে না? একটা নাস্কিার দিতাছি মোবাইল দেন। লিফট চালুর ব্যবস্থা হইব।
আমার কাছে মোবাইল সেট নাই।
চিন্তার কিছু নাই। টুলের উপরে বসেন।
ঠিক হতে কতক্ষণ লাগবে?
বলা তো আফা মুশকিল। আইজ ছুটির দিন। লোকজন চইলা যাবে জুম্মার নামাজে।
এখন বাজে মাত্র এগারোটা, এখন কিসের জুম্মা?
একটা অজুহাতে আগেভাগে বাইর হওয়া। সবাই অজুহাত খুঁজে।
এ্যালার্ম বেল, এই জাতীয় কিছু নাই?
আছে। মনে হয় নষ্ট। রক্ষণাবেক্ষণ নাই। মাসে একবার সার্ভিসং করার কথা। তিন মাস হইছে সার্তিসিং নাই।
মনে হলো এক ঘণ্টা বসে আছি, ঘড়িতে দেখি মাত্ৰ সাত মিনিট পার হয়েছে। লিফটম্যানের সঙ্গে গল্প করা ছাড়া সময় কাটানোর কোনো বুদ্ধি নেই। আমি বললাম, আপনার নাম কি?
লিফটম্যান বলল, আমার নাম সালাম। আমার এক ছোটভাই আছে তার নাম কালাম। সেও লিফটম্যান। গুলশানের এক অফিসে কাজ করে। বেতন আমার চেয়ে বেশি পায়। চাইরিশ টাকা বেশি। ওভার টাইম পায়। আমাদের এইখানে ওভারটাইম নাই। ছুটির দিনে কাজে আসছি। একটা পয়সা মিলবে না।
আমি বললাম, লিফটম্যানের চাকরিটা মনে হয় খুব বোরিং, মানে ক্লান্তিকর।
সালাম বলল, উঠানামা, উঠা-নামা। এইটা কোনো চাকরির জাতই না। কি করব বলেন- লেখাপড়া শিখি নাই। তবে আমার ভাই কালাম ক্লাস সিক্স পাস।
আপনি বিয়ে করেছেন?
জে না। বেতন যা পাই তা দিয়া নিজেরই পেট চলে না, সংসার করব কি? তার উপর দেশে টাকা পাঠাইতে হয়। মা জীবিত। তয় আমার ভাই কালাম বিবাহ করেছে। মেয়ের বাড়ি টাঙ্গাইলের মধুপুর। তাদের একটা কন্যা আছে। কন্যার নাম রেশমা।
বয়স কত?
ফেব্রুয়ারিতে তিন বছর হবে। মাশাল্লাহ সব কথা বলতে পারে। আমারে ডাকে হাওয়াই চাচু।