কেউ প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে এমন শুনেছেন?
এক বুড়ো মানুষকে নিজে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখেছি।
লিফটে ভয় পাওয়া নিয়ে কোনো গল্প শুনেছেন?
আমি বললাম, একটা গল্প শুনেছি। গল্পের সত্য-মিথ্যা জানি না। এক লোক সাত তলা থেকে গ্রাউন্ড ফ্লোরে যাবে। লিফটের বোতাম টিপল। লিফটের দরজা খুলল। তিনি ভেতরে ঢুকে হুড়মুড় করে নিচে পড়ে গেলেন। কারণ লিফটের দরজা খুলেছে ঠিকই কিন্তু লিফট আসে নি। মেকানিক্যাল কোনো গণ্ডগোল হয়েছে।
লিফট নিয়ে কোনো ভূতের গল্প পড়েছেন?
স্টিফেন কিং-এর একটা গল্প পড়েছি। বেশ জমাট গল্প। সায়েন্স ফিকশন টাইপ।
মিসির আলি বললেন, আমি লিফট নিয়ে একটা গল্প বলব। এক তরুণী লিফটে উঠে এমনই ভয় পেল যে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। সে এখন এক ক্লিনিকে আছে। তার চিকিৎসা চলছে।
কি দেখে ভয় পেয়েছে?
এখনো পুরোপুরি জানি না। চলুন যাই চেষ্টা করে দেখি মেয়েটার মুখ থেকে কিছু শোনা যায় কি-না। সম্ভাবনা ক্ষীণ। ভয় পেয়ে যে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত সে ভয় কেন পেয়েছে সেই বিষয়ে মুখ খুলবে না। এটাই স্বাভাবিক।
আমি বললাম, মেয়েটার খোজ পেলেন কীভাবে?
মিসির আলি বললেন, ক্লিনিকের ডাক্তার আমাকে জানিয়েছেন। মেয়েটির ব্যাপারে সাহায্য চেয়েছেন। মেয়েটা তার আত্মীয়া। বোনের মেয়ে বা এই জাতীয় কিছু।
মেয়েটার নাম লিলি। বয়স ২৪/২৫ বা তারচে’ কিছু বেশি। গায়ে হাসপাতালের সবুজ পোশাক। সাধারণ বাঙালি মেয়ে যেমন হয় তেমন। রোগা, শ্যামলা। মেয়েটার চোখ সুন্দর। বিদেশে এই চোখকেই বলে Liquid eyes.
চাদর গায়ে সে জড়সড় হয়ে ক্লিনিকের খাটে বসে আছে। সে দুহাতে একজন বয়স্ক মহিলার হাত চেপে ধরে আছে। শব্দ করে নিশ্বাস ফেলছে। কিছুক্ষণ পর পর টোক গিলছে।
মিসির আলি বললেন, মা কেমন আছ?
লিলি তাকাল কিন্তু কোনো জবাব দিল না। বয়স্ক মহিলা বললেন, লিলি কারো প্রশ্নের জবাব দেয় না। শুধু বলে লিফটের ভিতর ভয় পেয়েছি। এর বেশি কিছু বলে না।
মিসির আলি বললেন, আপনি কি লিলির মা?
জি।
আপনাকেও বলে নি কি দেখে ভয় পেয়েছে?
না। বেশি কিছু জিজ্ঞেসও করি না। এই বিষয়ে জানতে বেশি জোরাজুরি করলে মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে যায়।
মিসির আলি লিলির সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, মা শোনো! তুমি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছ বুঝতে পারছি। এখন তুমি লিফটের ভেতরে নেই। লিফটের বাইরে। বাকি জীবন আর লিফটে না উঠলেও চলবে। চলবে না?
এই প্রথম লিলি কথা বলল। বিড়বিড় করে বলল, আমি আর কোনোদিন विश् टव না।
মিসির আলি বললেন, যে লিফটে উঠে তুমি ভয় পেয়েছ। সেখানে তুমি না। উঠলেও অন্যরা উঠবে। তারাও ভয় পেতে পারে। তাদের অবস্থাও তোমার মতো হতে পারে। পারে না?
পারে।
মিসির আলি বললেন, এই কারণেই তোমার ঘটনাটা বলা দরকার। একবার বলে ফেলতে পারলে তুমি নিজেও হালকা হবে। তুমি কি দেখে ভয় পেয়েছ তার একটা ব্যাখ্যাও আমি হয়তোবা দাঁড়া করিয়ে ফেলব।
লিলি স্পষ্ট গলায় বলল, আপনি পারবেন না।
মিসির আলি বললেন, পারব না বলে কোনো কাজে হাত দেব না। আমি সে রকম না। তুমি সে রকম। তুমি ধরেই নিয়েছ- লিফটে কি দেখেছ, তা বলতে গেলে প্ৰচণ্ড ভয় পাবে বলে বলছি না। তুমি না বললেও কি দেখেছি তা তোমার মাথার মধ্যে আছে। তাকে মুছে ফেলতে পারছি না।
লিলি বলল, আচ্ছা আমি বলব।
মিসির আলি বললেন, ভেরি গুড়। আগে এক কাপ চা খাও তারপর গল্প শুরু করো। কোনো খুঁটিনাটি বাদ দেবে না। লিফটে তুমি একা ছিলে?
আমি আর লিফটম্যান। আর কেউ ছিল না।
লিফটটা কোথায়?
মতিঝিলের এক অফিসে।
তুমি সেখানে কাজ করে?
লিলি বলল, আমি বিবিএ পড়ছি! এই জন্যে একটা ফার্মের সঙ্গে এফিলিয়েশন আছে। সেখানে সপ্তাহে একবার হলেও যেতে হয়। কাগজপত্র আনতে হয়।
মিসির আলি বললেন, গতকাল এই জন্যেই গিয়েছিলো?
মিসির আলি বললেন, গতকাল ছিল শুক্রবার। সব কিছু বন্ধ। বন্ধের দিন তুমি কাগজপত্র আনতে গেলে?
লিলি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। সে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। তার ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে। মিসির আলি বললেন, তুমি শুক্রবারে সেই অফিসে যাও?
আপনাকে কে বলেছে?
আমি অনুমান করছি। আমার অনুমান শক্তি ভালো। অফিসের ঠিকানাটা বলো।
আমি আপনাকে কিছুই বলব না।
মিসির আলি মেয়েটির মা’র দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার মেয়ে বাসায় ফিরেছে। কখন?
ভদ্রমহিলা বললেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে একজন ডাক্তার টেলিফোন করে লিলির কথা জানান। কে এসে না- কি লিলিকে হাসপাতালে দিয়ে গেছে।
আপনার মেয়ে কোথায় কোন অফিসে যায় আপনি জানেন?
না।
মেয়ের বাবা কোথায়?
বিদেশে। মালয়েশিয়ায় কাজ করেন।
মিসির আলি লিলির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তাহলে কিছুই বলবে না?
লিলি কঠিন গলায় বলল, না।
মিসির আলি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, তাহলে যাই। তুমি ভালো থেকো। আরেকটা কথা, মা শোনো— যা করবে ভেবেচিন্তে করবে। হঠাৎ বিপদে পড়া এক কথা আর বিপদ ডেকে আনা অন্য কথা।
লিলি বলল, আপনি যাবেন না। বসুন। আমি সব বলব। মা, তুমি অন্য ঘরে যাও।
ভদ্রমহিলা বললেন, আমি থাকলে সমস্যা কি?
লিলি বলল, তোমার সামনে আমি সব কিছু বলতে পারব না।
মিসির আলি আমাকে দেখিয়ে বললেন, ইনি কি থাকতে পারবেন?
লিলি বলল, হ্যাঁ পারবেন। উনি লেখক। আমি উনাকে চিনি। আমি আপনাকেও চিনি। আপনাকে নিয়ে লেখা দুটা বই আমি পড়েছি। একটার নাম মনে আছে- মিসির আলির চশমা। সেখানে একটা ভুল আছে। ভুলটা আমি দাগ দিয়ে রেখেছি। এখন মনে নাই।