আমি বললাম, আসুন আপনাকে ডাক্তার দেখাই।
রউফ মিয়া আঁতকে উঠে বললেন, অসম্ভব কথা বললেন। আমি বিখ্যাত রোগভক্ষক। এখন আমি যদি ডাক্তারের কাছে। যাই, লোকে কী বলবে?
কেউ তো জানছে না।
কেউ না জানুক আপনি তো জানলেন। একজন জানা আর এক লক্ষ জন জানা একই কথা।
রউফ মিয়া শীতের সময় এসেছিলেন। বাজারে নতুন সবজি উঠেছে। তার জন্যে বাজার করলাম। হামিদ অনেক পদ রান্না করল। তিনি কিছুই খেতে পারলেন না। দুঃখিত গলায় বললেন, ক্ষুধা নষ্ট হয়ে গেছে ভাই সাহেব। মানুষের রোগ ভক্ষণ করে করে এই অবস্থা হয়েছে। যদি সম্ভব হয় এক কাপ দুধ দেন।
আমি বললাম, রোগ খাওয়াটা ছেড়ে দিন।
রউফ বললেন, নিজের ছেলে একটা বিদ্যা শিখায়ে দিয়েছে। মানুষ বিপদে পড়ে আমার কাছে আসে। ভাই সাহেব, কয়েকদিন আগে ছেলেটাকে স্বপ্নে দেখেছি। সে এখনো তার মা’ক্সে খুঁজে পায় নাই। পরকালে বাপ-মা ছাড়া ঘুরতেছে, দেখেন তো অবস্থা!
রউফ মিয়া হঠাৎ বড় বড় করে নিশ্বাস নিতে নিতে শুয়ে পড়লেন। তাঁর মুখ থেকে ঘর্ঘর শব্দ হতে লাগল।
আপনার এ্যাজমা আছে না-কি?
রউফ মিয়া বললেন, আপে ছিল না। সম্প্রতি হয়েছে। একজনের হাঁপানি ভক্ষণ করে এই অবস্থা। আমাকে ধরে ফেলেছে। আপনার ছেলেটাকে একটু বলুন বুকে সরিষার তেল মালিশ করে দিতে। রসুন দিয়ে তোলটা পরম করতে হবে।
হামিদ দীর্ঘ সময় ধরে তেল ঘসিল। এক সময় রউফ মিয়া ঘুমিয়ে পড়লেন।
মিসির আলি থামলেন। আমি বললাম, আপনার রোগ মুক্তির পেছনে কি রোগভক্ষক রউফ মিয়ার কোনো ভূমিকা আছে।
মিসির আলি বললেন, জানি না। এই চিঠিটা পড়ে দেখুন। হামিদ ভোরবেলা চিঠিটা দিয়ে গেছে। রউফ আমাকে দেখতে এসেছিলেন। চিঠি লিখে বান্দরবান চলে গেছেন। মুরং রাজার এক আত্মীয়ের চিকিৎসার জন্যে ডাক এসেছে।
আমি চিঠি হাতে নিলাম। চিঠিতে লেখা—
প্ৰাপক জনাব মিসির আলি।
প্রেরক বিশিষ্ট রোগভক্ষক বাংলার গৌরব রউফ মিয়া।
জনাব,
বান্দরবানের মুরং, রাজার এক জ্ঞাতি ভ্ৰাতা উল্লাং প্রশ্ন সাহেবের চিকিৎসার জন্যে অদ্য সকল এগারোটায় রওনা হইব। ঢাকায় আসিয়া আপনার অসুখের খবর শুনিলাম! হামিদকে নিয়ে হাসপাতালে আসিয়া আপনার অচেতন মুখ দেখিয়া মৰ্মে আঘাত লাগিয়াছে। বিশিষ্ট রোগভক্ষক, বাংলার গৌরব যাহার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ভ্রাতাতুল্য তাহার এই অবস্থা কেন হইবে?
(বাংলার গৌরব টাইটেল বর্তমানে ব্যবহার করিতেছি। যে দেশের যে নিয়ম। নিজের ঢোল নিজেকেই বাজাতে হয়।)
যাই হোক, আমি আপনার ডান হাত চাটিয়া রোগ সম্পূর্ণই ভক্ষণ করিয়াছি। অবশিষ্ট কিছুই নাই। কিছুদিন শরীর দুর্বল থাকিবে। দধি এবং ফল খাইবেন। কচি ডাবের পানি শরীরের জন্যে রোগমুক্তি সময়ে অত্যন্ত উপকারী।
ইতি
আপনার
অনুগত
মোঃ রউফ মিয়া
বিশিষ্ট রোগভক্ষক
বাংলার গৌরব।
পুনশ্চ : জনাব, ভালো কাগজে একটা প্যান্ড ছাপাইতে কত খরচ পড়িবে সেই অনুসন্ধান নিবেন। প্যাডে। আমার নাম, ঠিকানা এবং টাইটেল লেখা থাকিবে। বাংলার গৌরব লেখা থাকিবে সোনালি কালিতে। প্যাডের ডান পার্শ্বে আমার ছবি। তিনটি ছবি সঙ্গে দিয়া দিলাম। যেটি পছন্দ হয় সেটি ব্যবহার করিবেন।
তিনটি ছবিরই ক্যাপশন আছে। একটিতে রউফ মিয়ার কানে মোবাইল টেলিফোন। ক্যাপশনে লেখা- রুগীর সঙ্গে বাক্যালপো রত।
দ্বিতীয় ছবিতে তিনি ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে চোখে কালো চশমা। ক্যাপশনে লেখা- কলে যাবার জন্য প্রস্তুত।
তৃতীয় ছবিতে তিনি একটি শিশুর কপাল চাটছেন। ক্যাপশনে লেখা–চিকিৎসা চলাকালীন ছবি।
চিঠি মিসির আলির হাতে ফেরত দিতে দিতে বললাম, আপনার কি ধারণা?
সে সত্যি রোগ খেয়ে ফেলেছে?
মিসির আলি বললেন, রউফ আমার কাছে এসেছিলেন রাত ন’টায়। তিনি পনেরো মিনিটের মতো ছিলেন। এর মধ্যে হাসপাতালে হৈচৈ পড়ে যায়। নার্সডাক্তার মিলে বিরাট জটলা। বুড়ো এক পাগল মেঝেতে বসে কুকুরের মতো আমার হাত চাটছে। তাকে দারোয়ান দিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হয়। আমার জ্ঞান ফিরে রাত দশটার দিকে। জ্বর তখনি নেমে যায়। রাত বারোটার সময় বুঝতে পারি আমি পুরোপুরি সুস্থ।
আমি বললাম, আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দেন নি। আপনার কি ধারণা রোগভক্ষক আপনার রোগ ভক্ষণ করেছে?
মিসির আলি বললেন, জানি না। হিসাব মিলাতে পারছি না। রেইন ফরেস্টের আদিবাসী শমন চিকিৎসকদের মধ্যে রোগীর বুড়ো আঙুল চুষে রোগ আরোগ্যের পন্থা আছে। রেড ইন্ডিয়ানরা গায়ে হাত বুলিয়ে রোগ সারায়। অধ্যাপক মেসমার বডি ম্যাগনেটিজম চিকিৎসার কথা বলতেন। এর কোনোটাই বিজ্ঞান স্বীকার করে। না। যুক্তি স্বীকার করে না। আমি নিজে কঠিন যুক্তিবাদী মানুষ। তারপরেও…।
মিসির আলি রেডিও বন্ড কাগজে প্যাড ছাপিয়েছিলেন। রোগভক্ষক রউফ মিয়ার কাছে সেই প্যাড পৌঁছানো যায় নি। বান্দরবান থেকে ঢাকা ফেরার পথে বাসে বমি করতে করতে তাঁর মৃত্যু হয়। মিসির আলি বন্ধুর মৃত্যুর খবর পান এক মাস পরে।
লিফট রহস্য
মিসির আলি বললেন, লিফটে উঠে কখনো ভয় পেয়েছেন?
আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় মহসিন হলের লিফটে এক ঘণ্টার জন্যে আটকা পড়েছিলাম। আমার সঙ্গে জীবনে প্রথম লিফটে উঠেছেন এমন এক বৃদ্ধ ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলেন। আমি নিজে ভয় পাই নি। দিনের বেলা বলেই লিফটে কিছু আলো ছিল। পুরোপুরি অন্ধকার ছিল না। আমি মিসির আলির দিকে তাকিয়ে বললাম, না।