আমি রউফ মিয়ার ঠিকানায় চিঠি লিখে তাকে ঢাকায় আসতে বললাম। রউফ মিয়া এলো না, তবে তার কাছ থেকে ছাপানো চিঠি চলে এলো। চিঠির শেষে রউফ মিয়ার আকাবাকা হাতে দস্তখত। লোকটি যথেষ্ট গোছানো তা বোঝা যাচ্ছে। চিঠির উত্তর ছাপিয়েই রেখেছে। চিঠিতে লেখা–
জনাব জনাবা মিসির আলি
সম্মান সম্ভাষণপূর্বক নিবেদন এই যে, আমার পক্ষে নিজ খরচায় আপনার কাছে যাওয়া সম্ভব নহে। রাহা খরচ বাবদ একশত টাকা মাত্ৰ’ পাঠাইলে তুরিত ব্যবস্থা নেওয়া হইবে।
রোগের জন্য আমার ফ্রি নিম্নরূপ
জটিল রোগ : পাঁচশত টাকা মাত্র
সাধারণ রোগ : আলোচনা সাপেক্ষে
সত্তরের বেশি বয়সের রোগী : চিকিৎসা করা হয় না।
হাড়ভাঙা রোগী চিকিৎসা করা হয় না।
শিশুদের জন্যে বিশেষ কনসেশনের ব্যবস্থা আছে।
ছাত্রদের জন্যে অর্ধেক কনসেশন। তবে হেডমাস্টার সাহেবের প্রত্যয়ন পত্র লাগবে।
ইতি
আপনার একান্ত বাধ্যগত
রউফ মিয়া
চিঠি পড়ে সঙ্গে সঙ্গেই আমি মানি অর্ডার করে একশ’ টাকা পাঠালাম। ইন্টারেটিং একটা চরিত্র দেখার আলাদা আনন্দ আছে।
টাকা পাঠানোর দশ দিনের মাথায় গাঢ় লাল রঙের ব্যাগ হাতে রউফ মিয়া আমার বাড়িতে উপস্থিত। অপুষ্ট শরীরের একজন মানুষ। গ্ৰাম্য গায়কদের মতো মাথায় বাবড়ি চুল। সব চুল পাকা। চোখে সস্তার সানগ্লাস। ভাদ্র মাসের গরমে গায়ে বুকের বোতাম লাগানো কোট। ময়লা শার্টের সঙ্গে হাতের ব্যাগের মতো নীল রঙের টাই। তার গা থেকে উৎকট বিড়ির গন্ধ আসছে। রউফ মিয়া বললেন, রোগী কে? আপনি অল্প কথায় রোগ বৰ্ণনা করেন। অধিক কথার প্রয়োজন নাই। সার্থকতাও নাই। সময় নষ্ট।
আমি বললাম, এত দূর থেকে এসেছেন। খানিকক্ষণ জিরিয়ে নেন। বাথরুমে যান, হাত-মুখ ধোন। দুপুরের খাওয়া নিশ্চয় হয় নাই। আসুন। একসঙ্গে খানা খাই।
রউফ বললেন, গোসলের ব্যবস্থা কি আছে? গরমে কাহিল হয়ে গেছি। আমার সঙ্গে লুঙ্গি-গামছা, তেল-সাবান সবই আছে। রোগী দেখতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে হয়। সব ব্যবস্থা সঙ্গে রাখি। দাঁতের খিলাল পর্যন্ত আছে।
আমি বললাম, গোসলের ব্যবস্থা অবশ্যই আছে। আপনি আরাম করে গোসল করুন। তাড়াহুড়ার কিছু নাই।
রউফ বললেন, অবশ্যই তাড়াহুড়া আছে। রাতে লঞ্চে করে চলে যাব ভোলায়। ভোলা থেকে কল পেয়েছি। বিশ্বাস না করলে আপনাকে চিঠি দেখাতে পারি।
আমি বললাম, কেন বিশ্বাস করব না? অবশ্যই বিশ্বাস করছি। যান গোসল সেরে আসুন। সোজা চলে যান। ডান দিকে বাথরুম।
রউফ বললেন, একটা বিড়ি খেয়ে ঠাণ্ড হয়ে তারপর বাথরুমে ঢুকব। সিগারেট খাবার সামর্থ্য আমার আছে। বিড়ি খাই কারণ সিগারেট আমাকে ধরে না। তাছাড়া বিড়ি কম ক্ষতিকর। সিগারেটে নানা কেমিক্যাল মিশায়। বিড়ি হচ্ছে নির্ভেজাল তামাক।
রউফ বিড়ি ধরিয়ে বুকে হাত রেখে বিকট শব্দে কাশতে লাগলেন। যিনি গ্যারান্টি দিয়ে অন্যের রোগ সারান, তিনি নিজেই অসুস্থ বলে মনে হলো।
দুপুরে রউফ মিয়া অতি তৃপ্তি করে খেলেন। কেউ সাধারণ খাবার তৃপ্তি করে খাচ্ছে দেখলে ভালো লাগে। আমি মুগ্ধ হয়ে তার খাওয়া দেখলাম। খাদ্য-বিষয়ক। কথা শুনলাম।
এটা কী? করলা ভাজি। সবাই কড়া করে করলা ভাজে। কালো করে ফেলে। আপনার বাবুর্চি সবুজ করে ভেজেছে। অসাধারণ। এই করলা ভাজি দিয়েই এক গামলা ভাত খাওয়া যায়।
ছোট মাছ দিয়ে সজিনা? সঙ্গে আবার কাচা আমি। বেহেশতি খানা। একপদ হলেই চলে! এরকম একটা পদ থাকলে অন্য পদ লাগে না।
ডালের মধ্যে পাঁচফুড়ন দিয়েছে? আবার ধনেপাতাও আছে? স্বাদ হয়েছে। মারাত্মক? ভাই সাহেব, আপনার এই বাবুর্চির হাতে চুমা খাওয়া প্রয়োজন।
খাওয়া শেষ করার পর ভদ্রলোক যে কাজটা করলেন তার জন্যে আমি প্ৰস্তুত ছিলাম না। তিনি আমার কাজের ছেলে হামিদকে ডেকে বললেন, বাবা, তোমার রান্না খেয়ে অত্যধিক তৃপ্তি পেয়েছি। এই পাঁচটা টাকা রাখো বখশিশ। আমি দরিদ্র মানুষ, এর চেয়ে বেশি দেবার সামর্থ্য নাই। তবে তোমার জন্যে খাস দিলে এখুনি আল্লাহপাকের দরবারে দোয়া করব। হাত তোলো দোয়ায় সামিল হও।
রউফ হাত তুলে দােয়া শুরু করলেন, হে আল্লাহপাক আজ অতি তৃপ্তি সহকারে যার রন্ধন খেয়েছি। তুমি তাকে বেহেশতে নাসিব করো। যেন সে বেহেশতি খানা খেতে পারে। যে পিতা-মাতা এমন এক বাবুর্চির জন্ম দিয়েছে। তাদেরকেও তুমি বেহেশতে নাসিব করো। আমিন।
দোয়া শেষ হবার পর দেখি হামিদের চোখে পানি। সে চোখ মুছে ফুঁপাতে লাগল।
আমি বললাম, আজ রাতটা আপনি ঢাকায় থেকে যান। হামিদ মাংস রাধুক। সে ভালো মাংস রান্না করে।
রউফ বললেন, আচ্ছা থাকলাম! ভোলার রোগী একদিন পরে দেখলেও ক্ষতি কিছু নাই। এতদিন রোগ ভোগ করেছে, আর একদিন বেশি ভোগ করবে। উপায় কি? সবই আল্লাহপাকের ইশারা। আপনার রোগী সন্ধ্যার পর দেখব। এখন শুয়ে কিছুক্ষণ। ঘুমাব। অতিরিক্ত ভোজন করে ফেলেছি।
রউফ মিয়া সন্ধ্যা পর্যন্ত নাক ডাকিয়ে ঘুমালেন। আমি হামিদকে বললাম রাতে ভালো খাবারের আয়োজন করতে। পোলাও, খাসির রেজালা, মুরগির কোরমা। বেচারা আরাম করে থাক। দুপুরে অতি সামান্য খাবার খেয়ে যে তৃপ্তির প্রকাশ দেখেছি তা আবার দেখতে ইচ্ছা করছে।
রউফ মিয়া যখন শুনলেন আমার কোনো রোগী নেই, আমি গল্প করার জন্যে তাকে টাকা পাঠিয়ে আনিয়েছি, তখন তিনি খুবই অবাক হলেন। আমি বললাম, ভাই রোগ আপনি কীভাবে সারান?