ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন, আমি আক্ষরিক অর্থেই হাঁফ ছাড়লাম। ভদ্রলোক দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে এসে বললেন, সিগারেটটা রাখেন।
আমি বললাম, কিসের সিগারেট?
বিয়ে বাড়ি থেকে এনেছিলাম যে সেই সিগারেট। ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলাম। ড্যাম্প হয়ে গেছে মনে হয়। খেতে না চাইলে রেখে দিন। সিগারেটখোর কোনো ভিক্ষুক পেলে দিয়ে দিবেন। অনেক ভিক্ষুক দেখেছি বিড়ি-সিগারেট ফুকে। পেটে নাই ভাত নেশার বেলা ষোল আনা।
ভদ্রলোক বিদায় নেবার দুঘণ্টা পর আবার এসে উপস্থিত। মাছের জার ফেরত চান। তার মেয়ে না-কি মাছের শোকে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। মেয়েকে অজ্ঞান অবস্থায় রেখেই তিনি মাছ নিতে সিএনজি ভাড়া করে এসেছেন।
আমার হাতে একশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে তিনি জার হাতে ট্যাক্সিতে উঠলেন। এক মিনিটও দেরি করলেন না।
আমি এই গল্পটি আমার Unsolved খাতায় তুলে রেখেছি কারণ ভদ্রলোক তার চরিত্র, কথার ভেতর পুরোপুরি প্রকাশ করেছেন। এই জাতীয় মানুষ কখনো মিথ্যা বলে না। বানিয়ে কিছু বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করার তো প্রশ্নই আসে না। এই চরিত্রের মানুষরা নিজেরা বিভ্রান্ত হতে চায় না, অন্যদেরও বিভ্ৰান্ত করতে চায় না। প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়ালে তারাই সবচে’ বেশি বিভ্রান্তিতে পড়ে। তাদের জারের মাছই হঠাৎ কোথাও চলে যায়। আবার ফিরে আসে। বিপুল এই বিশ্বের আমরা কতইবা জানি?
রোগভক্ষক রউফ মিয়া
মিসির আলি গুরুতর অসুস্থ। ২৩১ নম্বর কেবিনে তাঁকে রাখা হয়েছে। শ্বাসনালির প্ৰদাহ, নিউমোনিয়া, ফুসফুসে পানি- একসঙ্গে অনেক সমস্যা। পাঁচজন ডাক্তারকে নিয়ে একটা মেডিকেল টিম করা হয়েছে। মেডিকেল টিমের ভাষ্য হচ্ছে, মিসির আলি সাহেবের অবস্থা আশঙ্কাজনক। নিউজেনারেশন অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হচ্ছে। কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
আমি দারুণ দুশ্চিন্তা নিয়ে ২৩১ নম্বর কেবিন খুঁজে বের করলাম। ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে দেখি, মিসির আলি গম্ভীর ভঙ্গিতে বিছানায় বসা। তার হাতে বই। তিনি মন দিয়ে বই পড়ছেন। আমাকে দেখে বই বন্ধ করতে করতে বললেন, যে বইটি পড়ছি তাঁর নাম Windows of the mind. লেখকের নাম Stefan Grey. বিজ্ঞানের নামে অবিজ্ঞানের ব্যবসা। এইসব বই বাজেয়াপ্ত হওয়া দরকার। এবং এ ধরনের বইয়ের লেখকদের কোনো জনমানবহীন দ্বীপে পাঠিয়ে দেয়া দরকার। তাদেরকে সেখানে খাদ্য দেয়া হবে। লেখালেখি করার জন্যে কাগজ-কলম দেয়া হবে। তারা কোনো বই লিখে শেষ করা মাত্র ক্যাম্পফায়ারের আয়োজন করে লেখা পোড়ানো হবে। আবর্জনা মুক্তি উপলক্ষে গানবাজনার উৎসব হবে।
আমি বিছানার পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, শুনেছিলাম। আপনি অসুস্থ। মেডিকেল বোর্ড বসেছে। অবস্থা আশঙ্কাজনক।
মিসির আলি বললেন, গতকাল দুপুর পর্যন্ত অবস্থা আশঙ্কাজনকই ছিল। এখন পুরোপুরি সুস্থ। বাড়ি চলে যেতে চেয়েছিলাম, ডাক্তাররা যেতে দিচ্ছেন না। আমার অলৌকিক আরোগ্যলাভের ব্যাপারটা তাঁরা বুঝতে পারছেন না। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চান। আপনার ফলের ঠোঙ্গায় কি আম আছে?
আছে।
কাউকে ডেকে দুটা আম দিন। কেটে এনে দিক। আমি খেতে ইচ্ছা করছে। মারোয়াড়িরা কীভাবে আম খায় জানেন।
না।
তারা রাতে বাতি নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করে আম খায়।
তারা হলো জৈন সম্প্রদায়ের। তাদের ধর্মগুরুত্ব মহাবীর যে কোনো ধরনের প্ৰাণী হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন। আমে পোকা থাকলে সেই পোকা ‘হত্যা করা যাবে। না। কাজেই অন্ধকারে আম খাওয়া। দুএকটা পোকা অন্ধকারে যদি খাওয়া হয়ে যায় সেই দৃশ্য দেখা হবে না, কাজেই পাপও হবে না।
আম কেটে মিসির আলি সাহেবকে দেয়ার ব্যবস্থা হলো। তিনি আগ্রহ নিয়ে আম খাচ্ছেন। দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগছে। মরণাপন্ন রোগী দেখব বলে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি- এখন দেখছি রোগী স্বাস্থ্যে ও আনন্দে ঝলমল করছে। আমি বললাম, মেডিকেল মিরাকল ঘটল কীভাবে?
মিসির আলি বললেন, মিরাকালের ব্যাখ্যা হয় না। ব্যাখ্যা হলে মিরাকল আর মিরাকল থাকে না। যাই হোক, ঘটনা। কী ঘটেছে আপনাকে বলতে পারি। আমার জীবনের অনেক অমীমাংসিত রহস্যের একটি।
বলুন শুনি।
মিসির আলি বললেন, একটা শর্ত আছে। শর্ত পালন করলে শুনাব।
কী শর্ত?
সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। সিগারেট খাওয়ার ব্যবস্থা করুন। বারান্দায় দাড়িয়ে সিগারেট টেনে আসব, ডাক্তাররা টের পাবে না। এক প্যাকেট সিগারেট এবং একটা লাইটারের ব্যবস্থা করুন। শরীর নিকোটিনের জন্যে অস্থির হয়ে পড়েছে।
গল্প শোনার লোভে মিসির আলিকে সিগারেট এনে দিলাম। মিসির আলি কেবিনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মহানন্দে সিগারেট টানতে লাগলেন। একজন অ্যাটেনডেন্টকে দরজার সামনে বসিয়ে রাখা হলো। সে দর্শনার্থীদের বলবে— এখন ঢোকা যাবে না। রোগী ঘুমাচ্ছে।
মিসির আলি গল্প শুরু করলেন।
সবাই পত্রিকায় খবর পড়ে। আমি পড়ি বিজ্ঞাপন। একটি জাতির মানসিকতা, সীমাবদ্ধতা, অগ্ৰগতি সবকিছুই বিজ্ঞাপনে উঠে আসে। একযুগ আগের কথা বলছি- একটা অদ্ভুত বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল।
যে কোনো রোগ গ্যারান্টি দিয়া অ্যারোগ্য করি। আরোগ্য করিতে না পারিলে মাটি খাব।
রউফ মিয়া।
রউফ মিয়া বিজ্ঞাপনের নিচে ঠিকানা দেয়া এবং একটি টেলিফোন নাম্বার দেয়া! টেলিফোন নাম্বারের শেষে লেখা ‘অনুরোধে’।
আমি টেলিফোন করে রউফ মিয়াকে ডেকে দিতে অনুরোধ করলাম। যিনি টেলিফোন ধরলেন তিনি ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, ফাজলামি করেন? রউফ মিয়াকে ডাকা ছাড়া আমাদের অন্য কাজকর্ম নাই? আবার যদি টেলিফোন করেন মা-বাপ। তুলে গালি দিব।