মাছ কিনে এনে আমি জাহানারাকে বললাম, মা জাহানারা বেগম। কি বলি মন দিয়ে শোনো- এই দুটা মাছ তোমার। আজ থেকে তুমি এদের মা। ইংরেজিতে Mother, তুমি রোজ এদের খাবার দিবে। সকালে চার দানা। বিকালে চার দানা। বেশিও না কমও না। কম দিলে তারা ক্ষুধায় কষ্ট পাবে। বেশি দিলে অতি ভোজনে গায়ে চর্বি হবে। অতিরিক্ত চর্বি মানুষের জন্যে যেমন খারাপ মাছের জন্যেও খারাপ। বেশি খাওয়ালে এরা বেশি হাগবে। এইটা বললাম না। শিশুদের নোংরা কথা না বলা উত্তম।
কিছুদিন পরের কথা। জাহানারা আমাকে বলল, ভালো কথা, আমার মেয়ের ডাকনাম মালিহা কিন্তু আমি তাকে সবসময় ভালো নামে ডাকি। এতে গান্তীৰ্য বজায় থাকে। জাহানারা বেগম আমাকে বলল, বাবা! মাছ আমার সঙ্গে কথা বলে। আমাকে বলে জাহানারা কি করে?
আমি মেয়ের কথার কোনো গুরুত্ব দিলাম না। শিশুরা বানিয়ে বানিয়ে অনেক কিছু বলে এতে তাদের কল্পনা শক্তির বৃদ্ধি ঘটে। কয়েকদিন পরের কথা। জাহানারা বেগম আমাকে বলল, বাবা মাছ বলেছে- তুমি মহা বোকা।
এই কথায় আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল। কারণ আমি বুঝলাম। এই কথাটা মাছের কথা না। আমার মেয়ের কথা। সে তার মা’র কাছে শুনেছে। শিশুর কথা শিখে বড়দের শুনে শুনে। আমার এক বন্ধুর ছেলে, নাম জহির। সে দু’বছর বয়সেই সবাইকে ‘শালা’ বলে। কারণ আমার বন্ধু কথায় কথায় শালা বলে। বাবার কাছে শুনে শুনে শিখেছে। যাই হোক আমি শারীরিক শান্তির পক্ষের লোক। কথায় আছে spare the cane and spoil the child. বেতের চল উঠে গেছে বলে শিশু সম্প্রদায় এখন টেলিভিশনে আসক্ত হয়ে অধঃপতনের দোরগোড়ায়। ঢাকা শহরে বেত পাওয়া যায় না। আমি মুনশিগঞ্জের এক স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে বেত জোগাড় করে ঘরে রেখেছি। প্রধান শিক্ষকের নাম ইমামউদিন। আমার বন্ধুস্থানীয়। সম্প্রতি উমরা হজ করেছেন। আমার জন্যে এক বোতল জমজমের পানি এবং মিষ্টি তেঁতুল এনেছেন।
যে কথা বলছিলাম, আমি বেত্ৰাঘাতের মাধ্যমে মেয়েকে কিঞ্চিৎ প্রহার করলাম। এবং ঠিক করলাম মাছ বিদায় করব। যে দোকান থেকে কিনেছিলাম সেখানে কম মূল্যে বিক্রির চেষ্টা করব। তারা যা দিবে সেটাই লাভ। অবাক কাণ্ড দেখি মাছের জার আছে। পানি আছে মাছ দুটা নাই। মাছ যাবে কোথায়? একবার ভাবলাম আমার স্ত্রী লুকিয়ে রেখেছে। পরমুহুর্তেই মনে হলো সে কেন খামাখা লুকিয়ে রাখবে? সে তো জানে না যে আমি মাছ ফেরত দেবার পরিকল্পনা করেছি। তাহলে অন্য কোনো বাড়ির বিড়াল এসে কি মাছ খেয়ে ফেলেছে? এই যখন ভাবছি তখন হঠাৎ দেখি মাছের জারে মাছ ঠিকই আছে। সাতার দিচ্ছে। ডিগবাজি খাচ্ছে।
ঘটনা কিছুই বুঝলাম না। তাহলে কি চোখে ধান্ধা লেগেছিল? তা কি করে হয়। সবার চোখে একসঙ্গে ধান্ধা লাগে কি করে অবশ্য জাদুকর পিসি সরকার একবার সবার চোখে একসঙ্গে ধান্ধা লাগিয়েছিলেন। ম্যাজিক শো হবে। হল ভর্তি লোক। সন্ধ্যা সাতটায় শুরু হবার কথা। ন’টা বেজে গেছে। পিসি সরকারের খোেজ নেই। দর্শকরা বিরক্ত ৷ হৈচৈ হচ্ছে। এমন সময় পিসি সরকার মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন। দর্শকরা চিৎকার করে বলছে- দুই ঘণ্টা লেট। দুই ঘণ্টা লেট। পিসি সরকার বললেন, দুই ঘণ্টা লেট কেন বলছেন? আপনারা ঘড়ি দেখুন। এখন সাতটা বাজে। সবাই নিজের নিজের ঘড়ি দেখল। সবার ঘড়িতে সাতটা বাজে। সবাই একসঙ্গে হাততালি দিল।
এখন ভাই সাহেব। আপনি বলুন মাছ দুটা তো পিসি সরকার না যে ম্যাজিক দেখাবে। অত্যন্ত চিন্তিত বোধ করলাম। দশদিন পরের কথা, ঘরে তালা দিয়ে সবাইকে নিয়ে বিয়ের দাওয়াত খেতে গিয়েছি। আমার স্ত্রীর বাল্যকালের বান্ধবীর মেয়ের বিয়ে। আমার স্ত্রী চাচ্ছিল একটা শাড়ি দিতে। শাড়ি না দিলে তার না-কি মান থাকে না। আমি তাকে ধমক দিয়ে বলেছি বিয়ের উপহারে মানসম্মান নির্ভর করে না। আড়াইশ’ টাকা দিয়ে মন সিরামিকের একটা টি সেট দিয়েছি।
যে কথা বলছিলাম, দাওয়াত খেয়ে বাসায় এসে দেখি মাছ দুটা নাই। আগের মতো হয় কি-না। অর্থাৎ মাছ দুটা ফিরে আসে কি-না এটা দেখার জন্যে অনেকক্ষণ মাছের জারের সামনে আমি এবং আমার স্ত্রী বসে ঘুমের প্রস্তুতি শুরু করলাম। মাছ ফিরে এলো না। তখন মিষ্টি পান খেয়ে ঘুমাতে গেলাম। পান আমি খাই না। দাঁত নষ্ট করে। বিয়ে বাড়িতে পান-সিগারেট দিচ্ছিল। আমি নিয়ে এসেছি। সিগারেটটা রেখে দিয়ে পানটা খেলাম। সিগারেট ধরাব কি ধরাব না ভাবছি। না ধরালে নষ্ট করা হয়। আর ধরলে আয়ু ক্ষয়। এক পত্রিকায় পড়েছি– একটা সিগারেট এক ঘণ্টা আয়ু কমায়। দুটা টান দিয়ে সিগারেট ফেলে দিব এই যখন ভাবছি তখন কাজের মেয়ে এসে বলল, খালুজান মাছ দুইটা ফিরা আসছে। আমার কাজের মেয়েটার নাম জাইতরি। তাকেও বিয়ে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। তার স্যান্ডেল’ছিড়ে গিয়েছিল। খালি পায়ে তো আর বিয়ে বাড়িতে যাওয়া যায় না। ত্ৰিশ টাকা দিয়ে স্যান্ডেল কিনে দিয়েছিলাম। স্যান্ডেল সাইজে ছোট হয়েছে বলে অনেকক্ষণ সে ঘ্যানঘ্যান করেছে। আমি কি আর জানি মেয়ে মানুষের পা এত বড় হয়? এইটুকু এক মেয়ে তার এক ফুট লম্বা পা। চিন্তা করেন। অবস্থা। ধাবিড়াতে ইচ্ছা করে।
জাইতরির কথায় মাছের জারের কাছে গিয়ে দেখি সত্যি সত্যি মাছ দুটা ঘুরছে। তখন আমার স্ত্রী বলল, মাছ দুটা মিসির আলি সাহেবকে দিয়ে আসো। তিনি রহস্য সমাধান করবেন। সে-ই কোথেকে যেন আপনার ঠিকানা এনে দিল। রহস্য সমাধানের আমার প্রয়োজন নাই। দোষী মাছ বিদায় করতে পেরেছি। এতেই আমি খুশি। ভাই সাহেব আমি উঠি।