- বইয়ের নামঃ মিসির আলি আনসলভ্ড
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিরিজ বইঃ মিসির আলী
- প্রকাশনাঃ কাকলী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ ভূতের গল্প, সমগ্র, উপন্যাস, রহস্যময় গল্প, রোমাঞ্চকর গল্প
ছবি
তখন আমি উত্তরায় আস্ত একটা দোতলা বাড়ি ভাড়া করে একা থাকি। ব্যক্তিগত কারণে স্বেচ্ছা নির্বাসন বলা যেতে পারে। রান্নাবান্না করার জন্যে একজন বাবুর্চি রেখেছিলাম। তৃতীয় দিনে সে বাজার করার টাকা-পয়সা নিয়ে বের হলো, আর ফিরল না। চাল-ডাল-তেল অনেক কিছু কিনতে হবে বলে সে পনেরোশ’ টাকা নিয়েছিল। পরে দেখা গেল সে এই টাকা ছাড়াও আমার হাতঘড়ি, চশমার খাপ এবং টেবিলে রাখা রাজশেখর বসুর চলন্তিকা ডিকশনারিটাও নিয়ে গেছে। ডিকশনারি নেবার কারণ কিছুতেই স্পষ্ট হচ্ছে না। যে বাজারের ফর্দে কাচামরিচের বানান লেখে কাছা মরিচ, চলন্তিকা ডিকশনারির তার প্রয়োজন থাকলেও কাজে আসার কথা না। আমি ঠিক করে রাখলাম, মিসির আলি সাহেবের সঙ্গে দেখা হলে প্রসঙ্গটা তুলব। চলন্তিক ডিকশনারি সে কেন নিয়েছে এই ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই দিতে পারবেন। এরপর দু’বার তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। দু’বারই ভুলে গিয়েছি। তৃতীয়বার যেন এই ভুল না হয় তার জন্যে লেখার টেবিলে রাখা নোটবইতে লাল বলপয়েন্টে লিখে রেখেছি–
মিসির আলি
চলন্তিকা চুরি রহস্য
বর্ষার এক সন্ধ্যায় মিসির আলি উপস্থিত। তাঁর সঙ্গে মাঝারি সাইজের টকটকে লাল রঙের একটা ফ্লাস্ক। তিনি বললেন, চা এনেছি। চা খাবার জন্যে তৈরি হন। বলেই তিনি পাঞ্জাবির পকেট থেকে দুটা ছোট ছোট গ্লাস বের করলেন। আমি বললাম, বাসায় কাপ ছিল, পকেটে করে গ্লাস অ্যানার দরকার ছিল না।
মিসির আলি বললেন, যে চা এনেছি তা দামি চায়ের কাপে খেলে চলবে না। রাস্তার পাশে যেসব টেম্পরারি চায়ের দোকান আছে তাদের কাপে করে খেতে হবে। এবং দাঁড়িয়ে খেতে হবে।
আমি বললাম, দাঁড়িয়ে খেতে হবে কেন?
মিসির আলি বললেন, ঐ সব দোকানে একটা মাত্র বেঞ্চ থাকে। সেই বেঞ্চে কখনো জায়গা পাওয়া যায় না। দাঁড়িয়ে চা খাওয়া ছাড়া গতি কী? আরাম করে যে চা-টা শেষ করবেন। সেই উপায়ও নেই। ব্যস্ততার মধ্যে চা-পান শেষ করতে হবে। কারণ গ্রাসের সংখ্যা সীমিত। অন্য কাস্টমাররা অপেক্ষা করছে।
শিশুর পিতা শিশুর অন্তরে লুকিয়ে থাকে- কথাটা যেমন সত্যি তেমনি সব বড় মানুষের মধ্যে একজন শিশু লুকিয়ে থাকে তাও সত্যি। মিসির আলির মধ্যে লুকিয়ে থাকা শিশুটির কারণে আমাকে ফ্লাস্কের চা দাঁড়িয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে খেয়ে শেষ করতে হলো। মিসির আলি বললেন, প্রতিটি খাদ্যদ্রব্যের জন্যে পরিবেশ আলাদা করা। ভাপা পিঠা খেতে হয় উঠানে, চুলার পাশে বসে। চিনাবাদাম খেতে হয়। খোলা মাঠে, পা ছড়িয়ে অলস ভঙ্গিতে। মদ খেতে হয় কবিতার বই হাতে নিয়ে।
তাই না-কি?
মিসির আলি বললেন, আপনাদের কবি ওমর খৈয়াম সেই রকমই বলেছেন।
অল্প কিছু আহার মাত্র আরেকখানি ছন্দমধুর কাব্য হাতে নিয়ে। মিসির আলিকে নিয়ে বারান্দায় বসলাম। ভালো বর্ষণ শুরু হয়েছে। বারান্দা থেকে উত্তরা লেকের খানিকটা চোখে পড়ছে। হলুদ সোডিয়াম ল্যাম্পের কারণে
আপনাকে গল্প শোনাতে এসেছি।
আমি বললাম, নিজেই গল্প শুনাতে চলে এসেছেন, ব্যাপারটা বুঝলাম না। আপনার গল্প শোনার জন্যে তো অনেক ঝোলাকুলি করতে হয়।
মিসির আলি বললেন, আপনি হঠাৎ একা হয়ে পড়েছেন। সারাজীবন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আপনাকে ঘিরে ছিল। এখন কেউ নেই। আমি নিজে নিঃসঙ্গ মানুষ। নিঃসঙ্গতা আমার ভালোই লাগে। আপনার লাগার কথা না। গল্প বলে আপনাকে খানিকটা আনন্দ দেব। কোনো এক সময় গল্পটা। আপনি লিখেও ফেলতে পারেন।
আমি বললাম, Unsolved মিসির আলি?
হ্যাঁ। যে গল্পটা বলব। তার ব্যাখ্যা বের করতে পারি নি।
আমি বললাম, শুরু করুন। মিসির আলি বললেন, এখানে গল্প বলব না। ঘরের ভেতরে চলুন। আপনার দৃষ্টি বৃষ্টির দিকে। একজন কথক শ্ৰোতার কাছে পূর্ণ Attention দাবি করে। আমি গল্প বলব। আর আপনি বৃষ্টি দেখবেন তা হবে না।
গল্পের সঙ্গে আর কিছু লাগবে?
মিসির আলি বললেন, চা এবং সিগারেট লাগবে। ফ্লাঙ্কে চা আছে। সিগারেট আছে আমার পকেটে। ভালো কথা আমি আপনার জন্যে একটা বই নিয়ে এসেছি। স্যার্জ ব্রেসলি’র লেখা লিওনার্দো দা ভিঞ্চি।
বিশেষ করে এই বইটি আনার কোনো কারণ আছে কি?
মিসির আলি বললেন, আছে। কিছু বই আছে নিঃসঙ্গ অবস্থায় পড়তে অসাধারণ লাগে। এটা সে রকম একটা বই।
আমরা দু’জন শোবার ঘরে ঢুকলাম। মিসির আলি বিছানায় পা তুলে আয়োজন করে গল্প শুরু করলেন। এত আয়োজন করে তাকে কখনো গল্প বলতে শুনি নি।
আমি যে খুব চা-প্রেমিক লোক তা না। তবে রাস্তার পাশে অস্থায়ী চায়ের দোকানে চা খেতে ভালো লাগে। কেন ভালো লাগে তা বলতে পারছি না। এটা নিয়ে কখনো ভাবি নি।
শীতকালের দুপুর। বাসায় ফিরছি। পথে চায়ের দোকান দেখে রিকশা দাঁড় করিয়ে চা খেতে গেলাম। অনেকদিন এত ভালো চা খাই নি। চমৎকার গন্ধ। মিষ্টি পরিমাণ মতো। ঘন লিকার। চা শেষ করে দাম দিতে গেছি, দোকানি হাই তুলতে তুলতে বলল, দাম দিতে হবে না।
আমি বললাম, দাম দিতে হবে না কেন?
আপনে আজ ফ্রি।
ফ্রি মানে?
দোকানি বিরক্ত মুখে বলল, প্রত্যেক দিন পাঁচজন ফ্রি চা খায়। আইজ আপনে পাঁচজনের মধ্যে পড়ছেন। আর প্যাচাল পারতে পারব না। বিদায় হন।