আরিফের কথা শুনে রীমার তখন আবসারের কথা মনে পড়ল। ছেলেটার মধ্যে এমন একটা ক্ষমতা আছে, যার ফলে সে আগাম অনেক কিছু জানতে পারে। রীমা বলল, এত কিছু যখন বললেন তখন এর ফলাফলটা বললে খুব খুশি হতাম।
আরিফ হেসে উঠে বলল, সে খবর আল্লাহ পাক জানেন। মানুষ জানতে পারবে কেমন করে। তবে দোওয়া করি আল্লাহ আপনাদের ভবিষ্যৎ জীবন সুখের ও শান্তির
রীমা বলল, আমার কিন্তু বেশ ভয় ভয় করছে। আমার মত অসুন্দর মেয়েকে বিয়ে করে আপনার বন্ধু তার আত্মীয়স্বজনের কাছে হাস্যাস্পদ না হয়।
আরিফ আবার হেসে উঠে বলল, তা হয়তো প্রথম দিকে হতে পারে। তবে পরে যখন তারা তাদের ভুল বুঝতে পারবে তখন বরং সকলে ওকে দেখে হিংসা করবে।
রীমা বেশ অবাক হয়ে বলল, আপনি এসব কথা জানতে পারলেন কেমন করে?
আরিফ হাসতে হাসতে বলল, সব অনুমান করে বললাম, তবে আমার অনুমান বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সত্য হয়। এখন এসব কথা থাক, আমাকে ডেকে নিয়ে আসি। তারপর সে ভিতরে চলে গেল।
একটু পরে আরিফ মাকে নিয়ে ফিরে এল।
আবসার সালাম দিয়ে এগিয়ে এসে কদমবুসি করে বলল, আমি আরিফের বন্ধু।
তার দেখাদেখি রীমাও ওনাকে কদমবুসি করতে এলে সুফিয়া বেগম তার হাত ধরে পাশে বসিয়ে বললেন, বেচে থাক মা, আল্লাহ তোমাদেরকে সুখী করুক। তোমাদের কথা আরিফের কাছে শুনেছি। এমন সময় ওমরের বৌ আনোয়ারা চা-নাস্তা নিয়ে এলে সুফিয়া বেগম বললেন, তোমরা নাস্তা খেয়ে গল্প কর, আমি আসছি। তারপর তিনি চলে গেলেন।
নাস্তা খাওয়ার পর আনোয়ারা কাপ প্লেট নিয়ে চলে যাবার পর আরিফ রীমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনাকে কয়েকটা কথা বলব, কথাগুলো শুনে কিছু মাইন্ড করতে পারেন, তাই অনুমতি চাচ্ছি।
রীমা বলল, আপনি নিশ্চিন্তে বলুন, আমি কিছু মাইন্ড করব না।
আরিফ বলল, আপনি নিশ্চয় নামাজ-কালাম পড়েন?
হ্যাঁ পড়ি।
কেন পড়েন বলুন তো?
রীমা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, এগুলো করার জন্য আল্লাহ পাক কোরআনে মানুষকে হুকুম করেছেন।
আরিফ বলল, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। কিন্তু আল্লাহ পাক কোরআনে পুরুষদের পোশাক সম্বন্ধে ডাইরেক্ট কিছু না বললেও মেয়েদের পোশাক সম্বন্ধে অনেক কিছু বলেছেন। যেমন- তাদেরকে বাইরে বেরোবার সময় আলাদা কাপড় দিয়ে সমস্ত শরীর ঢেকে বের হতে বলেছেন। যাতে করে মেয়েদের সৌন্দর্য যেন পুরুষের নজরে না পড়ে। আল্লাহ পাকের এই হুকুম কেন মেয়েরা মেনে চলে না বলতে পারেন? আপনি মেয়ে বলে জানার জন্য প্রশ্নটা করলাম। আপনাকে অপমান করার জন্য করিনি।
রীমা সালওয়ার কামিজ পরে বুকের উপর শুধু সরু একটা ওড়না ঝুলিয়ে রেখেছে।
আরিফের কথা শুনে লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে রইল। কোন কথা বলতে পারল না।
তাই দেখে আরিফ বলল, আমার কথা শুনে আপনি খুব লজ্জা পেয়েছেন মনে হচ্ছে। আপনাকে লজ্জা দেবার জন্য আমি কথাটা কিন্তু বলিনি। আমি শুধু জানতে চাই, মেয়েরা আল্লাহর হুকুম মোতাবেক নামাজ পড়ে, কোরআন পড়ে, রোজা রাখে, অথচ যেভাবে তাদেরকে পোশাক-পরিচ্ছদ পরতে বলা হয়েছে তা পরে না। এর কারণ আমি ভেবে পাই না। অথচ তাদের জানা উচিত ঐ সব পোশাক পরা যেমন শরীয়তে নিষিদ্ধ তেমনি ঐ রকম পোশাক পরে কোন ইবাদত করলেও তা কবুল হয় না। বিশেষ করে আজকাল মেয়েরা মাথায় কাপড় বা রুমাল দিয়ে ঢেকে রাখতে চায় না। মাথার চুল পর পুরুষকে দেখানও শরীয়তে নিষেধ। এই কথাটা উচ্চ ফ্যামিলির মেয়েরা অনেকে জানে। কিন্তু তাদের অনেকে এবং মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মেয়েরা জেনেও মানে না। এর কারণ আপনি বলতে পারলেও লজ্জায় হয়তো বলতে পারছেন না। অথবা আপনার জানা নেই। তাই আমি যা মনে করি বলছি শুনুন, আজকাল অনেক মেয়ে মাথায় কাপড় দেওয়া বা রুমাল দিয়ে চুল ঢেকে রাখতে বা মুখমন্ডল ঢেকে রাখতে মজা বোধ করে। তারা ভাবে-এটা করলে লোকে তাদেরকে আনকালচাঙ অববে। এগুলো অশিক্ষিত মেয়েদের ব্যাপার। অথচ তারা মাথা উক্ত রেখে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ করতে চায়। আবার অনেকে ভাবে বিয়ের পর মেয়েদের মাথায় কাপড় দিতে হয়, কিন্তু আজকাল বিয়ের পরও মেয়েরা মাথায় তো কাপড় দেয় না বরং এমন পোশাকে বাইরে বেরোয়, তাতে করে তারা নিজেদেরকে কুমারী মেয়ে বলে পুরুষদের কাছে অবহিত হতে চায়। এটা শরীয়তের দৃষ্টিতে সরাসরি হারাম। শরীয়তে কুমারী বা বিবাহিতা সব বালেগ মেয়েদেরকে বাইরে বেরোবার সময় সারা শরীর ঢেকে নিতে আদেশ করেছে। আসলে শিক্ষিত শ্রেণীর বা উচ্চ ফ্যামিলির মেয়েরা বিধর্মীদেরকে বেশি অনুসরণ করে তাদের সভ্যতা গ্রহণ করছে। তাদের জানা উচিত, এটা ইসলামের দৃষ্টিতে সরাসরি নিষিদ্ধ। তাদের আর দোষ দেব কি। তাদের বাবা-মা বা স্বামীরা এর জন্য বেশি দায়ী। তারা হাদিসের আইন-কানুন না জেনে বিধর্মীদের সবকিছু দেখে ভাল মনে করে। নিজেদেরকে ও তাদের ছেলেমেয়েদেরকে সেই রকমভাবে গড়ে তুলছে। ফলে ইসলাম তাদেরকে কি পোশাক পরতে বলেছে তা তারা জানে না। এবং জানতেও চেষ্টা করে না। আসল কথা কি জানেন, এর ফলে তাদের দেখা-দেখি নিন শ্রেণীর সমাজের মেয়েরাও তাদেরকে অনুসরণ করছে। যার ফলে সব শ্রেণীর মেয়েরা আজকাল তাদের দেহবরী দেখিয়ে নিজেদের সৌন্দর্য জাহির করছে। এতে করে যে সমাজের অবক্ষয় হচ্ছে, সে দিকে কেউ লক্ষ্য করছে না। মেয়েদের সঙ্গে সনে হেলেরাও বিদেশী সভ্যতার দিকে ঝুকে পড়ছে। আর আমাদের মুসলমান সমাজের অবক্ষয়ের প্রধান কারণ হল, ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশা। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি এবং অফিস আদালতে যেভাবে ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশা চলহে এটা ইসলামে একেবারে নিষেধ। তাই বলে ইসলাম মেয়েদেরকে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি করে রাখতে বলেনি। আল্লাহপাক তাদেরকে যে স্বাধীনতা দিয়েছে, তা জেনে যদি তারা সেইরকমভাবে স্কুল, কলেজ, ভাসিটি বা অফিস-আদালতে যাতায়াত করত, তাহলে আমাদের সমাজের এত অবক্ষয় হত না। একটা জিনিস বোধ হয় সবাই বুঝতে পেরেছে, মেয়েদের অবাধ স্বাধীনতার ফলে এবং তাদের স্বেচ্ছাচারিতার ফলে তারা পুরুষ কর্তৃক বেশি ধর্ষিতা ও নাতি হচ্ছে। আমরা অনেকে বলে থাকি- মেয়েদের শিক্ষিত করে তুলতে এবং তাদেরকে সাবলখী করে তুললে, তারা পুরুষ কর্তৃক এত ধর্ষিতা ও লাতাি হত না। কথাটা কিছুটা সত্য হলেও বাস্তবে তার নজীর খুব কম পাওয়া যায়। কারণ বহু শিক্ষিত ফ্যামিলিতে বামী-লীর মধ্যে সুখ-শান্তি বলতে কিছুই নেই। অথচ তারা দুজনেই উপার্জন করে। ইসলাম মেয়েদেরকে প্রয়োজনের তাগিদে উপার্জনের কথা বলেছে। বড় লোক হবার জন্য বা আয়েশ আরামে থাকার জন্য অথবা ভোগবিলাসে মত্ত থাকার জন্য অনুমতি দেয়নি। যে দেশে লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত যুবক চাকরি না পেয়ে হতাশায় ভুগছে, ড্রাগ নিচ্ছে, মা-বোনের ভরণ-পোষণে ব্যর্থ হয়ে অকাজ-কুকাজ করছে, আহননের পথ বেছে নি, আর সে দেশে সচ্ছল পরিবারের মেয়েরা চাকরি করে ভোগবিলাসে মত্ত রয়েছে। কি করে তারা আরো ধনী হবে, সেই চো করছে। আমার কথাগুলো হয়তো সবার কাছে ভাল লাগবে না : কিন্তু তাদেরকে একটু চিন্তা করে দেখার অনুরোধ করব এবং এ সম্বন্ধে কোরআন-হাদিসে কি আছে তা জানার জন্যও অনুরোধ করব। এক মুসলমান আর এক মুসলমানের ভাই। এটা কোরআনের কথা। আমি মুসলমান হয়ে যদি নিজে ভোগবিলাসের জন্যে, অন্য মুসলমানের ডালভাতের দিকেও লক্ষ্য না রাখি, তাহলে আমরা মুসলমান থাকতে পারি না। শুধু ঐ সব মেয়েদেরকে উপার্জনের অনুমতি ইসলাম দিয়েছে, যারা উপার্জন না করলে তাদের পরিবারের সবাই না খেয়ে থাকবে। অথবা ছেলেমেয়েদেরকে মানুষ করার জন্য অথবা মান-সম্মান বজায় রেখে বেঁচে থাকার নয়। সেখানেও বিধি-নিষেধ দেওয়া হয়েছে, কিভাবে তারা উপার্জন করবে। যাই হোক এবার আপনাদের দুজনকে আর একটা কথা বলে আমি ইতি টানব। জীবন সঙ্গী বা সঙ্গিনী পছন্দ করা খুব দুরূহ ব্যাপার। আপাতদৃষ্টিতে আমরা যা ভাল মনে করি, তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মন্দ হয়। তবে মেয়েরা যদি স্বামীকে তার প্রাপ্য সম্মান দেয়, তাহলে তাদের দাম্পত্য জীবন খুব সুখের হয়। অবশ্য স্বামীকেও তার স্ত্রীর প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। কারণ একজনের দ্বারা কোন কাজ সুভাবে সম্পন্ন হয় না। হাদিসে আছে, স্বামী স্ত্রীর অর্ধেক আর স্ত্রী স্বামীর অর্ধেক। দুজনে মিলে পূর্ণ এক হয়। হাদিসে আরো আছে, স্বামীর প্রতি যতটা স্ত্রীর হক আছে, স্ত্রীর প্রতি স্বামীরও ততটা হক আছে। আজকাল স্বামী স্ত্রী সে সব হকের কথা জানে না বলে দাম্পত্য জীবনের সুখ-শান্তি থেকে তারা উভয়ে বঞ্চিত হচ্ছে এবং সংসার জীবন অশান্তিময় হয়ে উঠছে। কেউ কারো কথা মেনে চলতে চাচ্ছে না। এটা হওয়ার একমাত্র কারণ ধর্মীয় জ্ঞানের ও তার অনুশীলনের অভাব এবং দূষিত পরিবেশের ফলাফল। আপনারা দুজন সংসার জীবনে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। একে অপরের ছোটখাট দোষত্রুটিগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। এবং কোন বিষয়ে মতবিরোধ হলে দুজনে রাগারাগি না করে মিলেমিশে তার সমাধান করার চেষ্টা করবেন। যদি তা পারেন, তাহলে দেখবেন আপনাদের দাম্পত্য জীবন কত শান্তির হবে। আমি আর বেশি কিছু বলব না, আমার কথা শুনে বিরক্ত হলে ক্ষমা করবেন।