রীমা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, বেশ তাই হবে। সে সব বলার জন্য। সময়ের দরকার। সময় মত একদিন বলব। এবার বলুন ক্ষমা করেছেন?
আবসার বলল, সেদিন খুব মর্মাহত হয়েছিলাম ঠিক কথা, তবে তোমার ব্যবহারের কথা চিন্তা করে বুঝতে পেরেছিলাম, এর পিছনে নিশ্চয় কোন কারণ আছে। তাই সেদিনই মনে মনে ক্ষমা করেছি। তবে কারণটা জানার জন্য মন খুব উদগ্রীব হয়ে আছে।
রীমা ডিজে গলায় বলল, তোমার অনুমান ঠিক। আমার জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে, সে কথা মনে পড়লে আমি বিবেক হারিয়ে ফেলি। একদিন তোমাকে সে কথা বলব।
আবার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, এবার চল, নচেৎ অফিসে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে। কাল শুক্রবার। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে সেই বন্ধুর বাসায় যাব। সেই সময় তোমার সব কথা শুনব।
রীমা বলল, ঠিক আছে, তাই হবে।
২. শুক্রবার দিন আবসার রীমাকে নিয়ে
শুক্রবার দিন আবসার রীমাকে নিয়ে একটা বেবী করে আরিফের বাসায় রওয়ানা দিল। রীমা বেবীতে বসে চাচাতো ভাইয়ের ঘটনাটা সংক্ষেপে বলে বলল, তুমি সেদিন যখন দূরে থাকার কথা বললে তখন সেই কথা মনে করে তোমার সঙ্গে এ রকম দুর্ব্যবহার করে ফেলি। সেদিন তুমি চলে যাবার পর লজ্জায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল। তারপর চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে আবসারের একটা হাত ধরে বলল, তুমি যদি এখন আমার গালে চড় মেরে প্রতিশোধ নিতে, তাহলে হয়তো মনে শান্তি পেতাম।
আবসার বলল, মারবার আগেই তো কাঁদছ, মারলে তো জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। তারপর তার চোখের পানি মুছে দেবার সময় বলল, অনুশোচনার মারটাই বড় মার, তোমার গালে চড় মারব, কথাটা ভাবতে পারলে কি করে? ওসব কথা এখন থাক, যে বন্ধুর কাছে নিয়ে যাচ্ছি তার কথা বলছি শোন। সে প্রথম জীবনে বড় দুরন্ত ছিল। তারপর কেমন করে কি জানি তার পরিবর্তন হয়। ছেলেটা যেমন পড়াশুনায় ভাল তেমনি সব দিক দিয়ে জিনিয়াস। আমি তো ধর্মকর্ম সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না এবং মানতাম না। ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব হবার পর, ধর্ম সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করি এবং যতটা পারি মেনে চলতে চেষ্টা করি। সে যদি কিছু জিজ্ঞেস করে খুব বুঝে-সুজে উত্তর দিয়ো।
রীমা বলল, তার সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব হল কি করে?
আমিও খুব দুরন্ত ছিলাম। ভার্সিটিতে পড়ার সময় পার্টি করতাম এবং একবার ইলেকসনের সময় অন্য পার্টির ছেলেরা আমাকে একা পেয়ে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছিল, সে সময় আমি বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করেছিলাম। তারপর তারা আমার মাথায় কি দিয়ে যেন আঘাত করে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন জ্ঞান ফিরল দেখি আমি একটা ক্লিনিকে। আর আরিফ আমার পাশে। আরিফ খুব ধুরন্ধর ছেলে। সে কথা অর্সিটির সব ছেলেমেয়েরা জানত। আমিও জানতাম। কিন্তু সে কোন পার্টি করত না। তাকে দেখে বুঝতে পারলাম, সেই আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করেছে। তারপর থেকে আমি ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করি। আমাদের আর্থিক অবস্থার কথা জানতে পেরে অনেক সময় টাকা-পয়সা দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছে। কয়েক দিন আগে দেশে যাবে বলেছিল। তার মায়ের অসুখ, ফিরেছে কিনা কে জানে।
রীমা আর কিছু না বলে চুপ করে রইল।
আরিফের বাসার কাছে এসে বেবি বিদায় করে আসার গেটে নক করল। একটা পাড়াগাঁয়ের আটপৌরে শাড়ী পরা আধবয়সী মেয়ে দরজা খুলে বলল, কাকে চান?
আবসার জানে এই বাসায় আরিফ একা থাকে। তাকে দেখাশোনা ও রান্না করে খাওয়ার জন্য তাদের দেশের একজন বয়স্ক লোক থাকে। আরিফ তাকে ওমর চাচা বলে ডাকে। আজ একটা মেয়েকে দেখে বেশ অবাক হয়ে বলল, তুমি কে? ওমর চাচা নেই?
মেয়েটা বলল, সে বাজারে গেছে। আমি বেগম সাহেবের সঙ্গে এসেছি। আপনি কাকে চান? ওমরের বৌ আনোয়ারাকে সুফিয়া বেগম ও গোফরান সাহেব যখন ঢাকায় আসেন তখন সঙ্গে নিয়ে আসেন।
আবসার বলল, আমরা আরিফের কাছে এসেছি। সে কোথায়?
মেয়েটি বলল, ছোট সাহেব বেগম সাহেবের সঙ্গে কথা বলছেন। আপনারা ভিতরে এসে বসুন, ডেকে দিচ্ছি। কথা শেষ করে সে চলে গেল।
মেয়েটি চলে যাবার পর আবসার রীমাকে বলল, এস, বসা যাক। বসার পর বলল, মনে হয় ওর মা এসেছেন।
একটু পরে আরিফ এসে সালাম বিনিময় করে বলল, কিরে আকার, কেমন আছিস? তারপর রীমার দিকে এক পলক চেয়ে নিয়ে আবসার বলল, আমি যেতে পারিনি বলে ওকে সাথে করে নিয়ে এসে পড়েছিস, তাই না? ভালই করেছিস। আম্মা এসেছে, আব্বাও দুএকদিনের মধ্যে আসবে। আমি নাকি শুধু পড়াশুনা করি, খাওয়া-দাওয়ার দিকে লক্ষ্য রাখি না। তাই পরীক্ষা না হওয়া পর্যন্ত আম্মা এখানে থাকবে। তা তোদের বাসার খবর সব ভাল?
আবসার বলল, আল্লাহ পাকের রহমতে ভাল। তোর আম্মার অসুখ বলেছিলি, এখন কেমন আছেন?
আরিফ বলল, অসুখ হয়েছিল, তবে আমি যাবার আগে ভাল হয়ে গেছে। বস, আম্মাকে ডেকে নিয়ে আসি। তোর কথা মাকে অনেক বলেছি।
আবসার বলল, মাকে পরে ডাকি, তার আগে রীমার সঙ্গে তোর পরিচয় করিয়ে দিই।
আরিফ বলল, তার আর দরকার নেই। দেখেই বুঝতে পেরেছি। তারপর রীমার দিকে চেয়ে বলল, আপনার নাম রীমা জানতে পারলাম। আর আমার নাম যে আরিফ তা নিশ্চয় ওর কাছে শুনেছেন? এর পর আর পরিচয় হবার কি কিছু বাকি আছে? আপনারা দুজন দুজনকে পছন্দ করেন এবং খুব শিগগিরই বিয়ে করার কথাও হয়তো দুজনে বলাবলি করেছেন।