আবসার রীমার কথা শুনে ও তার স্পর্ধা দেখে যেমন ভীষণ রেগে গেল তেমনি মর্মাহত হল। চিন্তা করল, সে এই সামান্য কথায় আমাকে ইতর ভেবে রেগে গেল কেন? হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল, জানি না কেন তুমি আমার সঙ্গে এরকম দুর্ব্যবহার করলে। তবু আমি কি বলতে চাচ্ছিলাম তা বলে চলে যানি তুমি আমাকে আপনি সম্বোধনে কথা বলছিলে, তাই তুমি করে বলার জন্য অনুরোধ করতে চাচ্ছিলাম। এতে যদি আমি ইতর, অভদ্র ও ছোট লোক হয়ে থাকি, তাহলে আর কিছু বলার নেই। আজ থেকে কোন দিন এতটুকু তোমাকে আর বিরক্ত করব না। আসি, আল্লাহ হাফেজ। কথা শেষ করে সে হন হন করে পার্কের গেটে এসে একটা রিক্সায় উঠে বাসার ঠিকানা বলল।
আবসারের কথা শুনে রীমার হুশ হল। সে এতক্ষণ আগের জীবনের কথা ভেবে বাস্তবে ছিল না। আবসারকে চলে যেতে দেখেও তাকে বাধা দেবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল। নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল। একবার তার মনে হল, ছুটে গিয়ে আবসারের কাছে অপরাধের কথা স্বীকার করে ক্ষমা চাইবে। কিন্তু তা কাজে। পরিণত করতে পারল না। স্থানুবত দাঁড়িয়ে তার চলে যাওয়া দেখল। তারপর ধীরে ধীরে পার্কের গেটের দিকে আসতে লাগল। গেটের বাইরে এসে এদিক-ওদিক তাকিয়ে তাকে দেখতে না পেয়ে নিশ্চিত হল, সে চলে গেছে। তখন অনুশোচনায় তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। কিছুক্ষণের মধ্যে সামলে নিয়ে একটা রিক্সায় উঠে বাসার পথে রওয়ানা হল।
আবসার বাসায় ফেরার পথে চিন্তা করতে লাগল, রীমা নিশ্চয় এর আগে কোন ছেলের কাছে দুর্ব্যবহার পেয়েছে। তাই সে আমার কথা বুঝতে না পেরে আমাকে ভুল বুঝল। অপেক্ষা করে দেখা যাক, এরপর সে কি করে।
এদিকে রীমা ফেরার পথে ভাবল, আমি দেখতে খারাপ বলে কেউ আমাকে বিয়ে করতে না চাইলেও আমার স্বাস্থ্য ভাল বলে সবাই আমাকে ভোগ করতে চায়। রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করার সময় আবাল বৃদ্ধ আমার শরীরের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। এমন কি আমার অফিসের কলিকদেরকেও লোভাতুর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখি। কিন্তু আবসারের চোখে সে রকম কিছু দেখিনি। তার সঙ্গে মাত্র দুদিনের পরিচয় তাতেই মনে হয়েছে, অন্যদের মত তার দৃষ্টিতে সেরকম কিছু দেখিনি। যদি তা না হত, তাহলে এক কথায় বিয়ে করতে রাজী হত না। আমি ভুল বুঝে তার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি। আম, সে যে বলল, আর আমাকে বিরক্ত করবে না। -তাহলে কি সত্যি সত্যি আমার সঙ্গে আর দেখা করবে না? আমাদের বাসার সামনে দিয়ে তো তার অফিসে যাওয়ার রাস্তা, দেখা নিশ্চয় হবে। তবে সে হয়তো না দেখার ভান করে চলে যাবে। আমি যদি তার কাছে অন্যায় স্বীকার করে ক্ষমা চাই, তাহলে কি সে আমাকে ক্ষমা করবে না? বাসায় এসে ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিল, কয়েকদিন অপেক্ষা করে দেখবে সে কি করে। তারপর না হয় একদিন তার কাছে ক্ষমা চাইবে।
পরের দিন থেকে আবার অফিসে যাবার রাস্তা পরিবর্তন করল। যদিও এই রাস্তায় তার সময় বেশি লাগে তবু সে আগের রাস্তায় যাতায়াত বন্ধ করে দিল।
রীমা কয়েকদিন নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করে আবসারকে দেখতে না পেয়ে ভাবল, সে নিশ্চয় অন্য পথে যাতায়াত করছে। তাই একদিন বাসষ্ট্যান্ডে এসে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর আবারকে আসতে দেখে তার দিকে এগিয়ে গেল।
আবসার প্রথমে রীমাকে দেখতে পায়নি। রীমা কাছাকাছি এলে দেখতে পেয়েও না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। এমন সময় রীমার গলা শুনতে পেল, এই যে আবসার সাহেব, একটু দাঁড়ান না।
আবার অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে পড়ল।
রীমা তার সামনে এসে বলল, সেদিনের দুর্ব্যবহারের জন্য আমি খুব দুঃখিত। যা করেছি তা ক্ষমার অযোগ্য। তবু ক্ষমা চাইছি, দয়া করে ক্ষমা করে দিন।
আবসার কোন কথা বলল না। এমন সময় বাস আসতে বাসের দিকে চলে গেল।
রীমা নিশ্চল হয়ে তার দিকে চেয়ে রইল। বাস চলে যাবার পর সে নিজের অফিসের দিকে রওয়ানা দিল।
পরের দিন রীমা অফিস টাইমের একটু আগে বাসা থেকে বেরিয়ে যেদিক থেকে গতকাল আবসারকে আসতে দেখেছিল, সেদিকে ধীরে ধীরে হেঁটে এগিয়ে যেতে লাগল। এক সময় আবসারকে আসতে দেখে পথ আগলে দাঁড়িয়ে রইল। কাছে এলে সালাম দিয়ে বলল, আবসার সাহেব একটু দাঁড়ান, কথা আছে।
আবসার সালামের জবাব দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ইতর ও ছোটলোকদের সঙ্গে কথা বলা উচিত নয়। বলা তো যায় না, কখন ইতরামি করে ফেলি।
রীমা লজ্জা পেয়ে বলল, আপনার কথাটা সত্য। তবে যে তা নয়, তা কেউ যদি ভুল করে তাকে তাই মনে করে, এবং সে তার ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চায়, তাহলে তাকে ক্ষমা করা মহৎ গুণের পরিচয়, আপনি কি আমাকে ক্ষমা করতে পারেন না? যদি ক্ষমা করার আগে প্রতিশোধ নিতে চান তাতেও আমি রাজি। তবু ক্ষমা পেতে চাই।
ইতরদের ক্ষমা করার মহৎ গুণ নাও থাকতে পারে।
তা হয়তো ঠিক। কিন্তু সত্যি সত্যি যে ইতর নয়, সে পারে।
তারপর রীমা এগিয়ে এসে তার দুটো হাত ধরে হুলছল চোখে বলল, সেদিন থেকে অনুশোচনার আগুনে জুলছি। আপনার কাছ থেকে ক্ষমা না পাওয়া পর্যন্ত সে আগুন নিভবে না।
আবসার বলল, ক্ষমা তোমাকে করতে পারি। তার আগে তুমি আমাকে তুমি করে বলবে, আর সেদিন তুমি যে কারণে রেগে গিয়ে ঐসব বলেছ তা বলতে হবে।