গুলির আওয়াজ পেয়ে লোকজন রাস্তা থেকে সরে গিয়ে দূর থেকে ঘটনাটা দেখছিল। কেউ সাহস করে এগিয়ে এল না। আরিফের যেখানে গুলি গেলেছিল, সেখান থেকে রক্ত বেরিয়ে তার জামা-কাপড় ভিজে যাচ্ছে। সে পিস্তল দুটো এক হাতে নিয়ে অন্যহাতে জখমের জায়গাটা চেপে ধরে রেখে লোকজনের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল, পুলিশকে খবর দেবার মত আল্লাহর এমন কোন বান্দা কি এখানে নেই?
কোর্টে যে কয়জন পুলিশ ছিল, তারা চুনি ও পান্নার ফ্যানচাটা। তারও এতক্ষণ দৃশ্যটা দেখছিল। এবার এগিয়ে এল, তাদেরকে দেখে আরিফ বলল, এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিলেন, না? আপনাদের সহযোগিতায় এরা বিভিন্ন অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। এদের নিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ পরে তো ছেড়ে দেবেন?
এমন সময় শরীফ দারোগা জীপে করে কয়েকজন পুলিশ নিয়ে সেখানে এলেন। ইনি মাত্র একমাস হল এখানে বদলী হয়ে এসেছেন। অত্যন্ত সৎ ও বুদ্ধিমান লোক। এখানে আসার পর থানার অরাজকতা দেখে খুব মর্মাহত হয়েছেন। সবাইকে তিরস্কার করে সৎ উপদেশ দিয়েছেন। রেকর্ড পত্র দেখে চনি ও পান্নার সাথে অনেক কিছু জেনেছেন। একজন লোক থানায় এসে চুনি-পান্নার গোলমালের কথা জানাতে তিনি নিজে পাঁচ ছয়জন পুলিশ নিয়ে এসেছেন। আরিফের শেষের দিকের কথা কিছু শুনে। পুলিশদেরকে ওদের তিনজনকে আরেই করার অর্ডার দিয়ে আরিফকে উদ্দেশ্য করে বললেন, পুলিশদের মধ্যে কিছুসংখ্যক খারাপ থাকলেও ভাল লোকও আছে। আমি এদের দুজনের সব খবর নিয়েছি। এবার ওরা দশ-বিশ বছরেও ছাড়া পাবে কিনা সন্দেহ।
আরিফ পিস্তল দুটো শরীফ দারোগার হাতে দিয়ে বলল, আল্লাহ ন্যায় বিচারককে খুব ভালবাসেন। তারপর সে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
শরীফ দারোগা সবাইকে নিয়ে সদর হাসপাতালে গেলেন। সেখানে অপারেশন করে সবার গুলি বের করা হল। চুনি ও পান্নার দুজনের একটা করে হাত কেটে বাদ দিতে হয়েছে। হাসপাতালে তাদের বেডের কাছে কড়া পুলিশ পাহারা রইল। শরীফ দারোগা মাঝে মাঝে আরিফের মুখ জবানী নেবার জন্য জ্ঞান ফিরেছে কিনা এসে দেখে যেতে লাগলেন।
পরের দিন খবর পেয়ে গোফরান সাহেব ও সুফিয়া বেগম হাসপাতালে এলেন। কিন্তু পুলিশ তাদেরকে আরিফের বেডের কাছে যেতে দিলেন না। সানোয়ার উকিলের সঙ্গে গোফরান সাহেবের খুব জানাশোনা। তাকে ধরে গোফরান সাহেব থানায় গিয়ে শরীফ দারোগার কাছে পরিচয় দিয়ে আরিফকে দেখার পারমিশন নিলেন। কিন্তু বেডের মছে থাকার পারমিশন পেলেন না। ওরা হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করলেন। মাঝে মাঝে এসে আরিফকে দেখে যেতে লাগলেন। সুফিয়া বেগম কেদে কেদে আল্লাহপাকের কাছে আরিফকে ভাল করে দেবার জন্য দোওয়া করতে লাগলেন।
আরিফ যেদিন আহত হয়, সেদিন ফাল্গুনী দুপুরে খাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে শুয়ে নজীবর রহমানের প্রেমের সমাধি বইটা পড়ছিল। বিয়ের রাত থেকে স্বামী দিনরাত্র নিষিদ্ধ পল্লীর একটা মেয়ের কাছে থাকত। স্ত্রী তাহমিনা এক নজরও স্বামীকে দেখেনি। তবু স্বামীর প্রতি তাহমিনার গভীর ভালবাসার কথা পড়ে ফাল্গুনীর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। ঠিক তখনই তার আরিফের কথা মনে পড়তে বুকের মধ্যে যন্ত্রণা অনুভব করল। যন্ত্রণাটা ক্রমশ বেড়েই চলছে বুঝতে পেরে তার মনে হল, আরিফের নিশ্চয় কোন বিপদ হয়েছে। জোহরের নামাজ পড়ে ভাত খেয়েছে। তার অজু এখনো ভাঙেনি। আস্তে আস্তে নামাজ পাটি বিছিয়ে দুরাকাত নফল নামাজ পড়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে দোয়া করল, আল্লাহপাক, তুমি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান এবং দয়ার সাগর। তোমার দয়া ব্যতীত কোন প্রাণী এক মুহুর্ত বাঁচতে পারে না। কেন জানি আমার মনে হচ্ছে, আরিফের কোন বিপদ হয়েছে। আমার এই নামাজের অসিলায় তুমি আরিফকে সহিসালামতে রেখ। যদি সে কোন বিপদে পড়ে, তাকে তুমি রক্ষা করো। তোমার রাসুলে পাক (দঃ)-এর উপর শতকোটি দরুদ ও সালাম পেশ করে ফরিয়াদ করছি, তোমার রহমত দিয়ে আরিফকে ঢেকে রেখ। আমি তিন জুম্মা নফল রোজা রাখব। সে যেন সুস্থ শরীরে ফিরে আসে। আমিন সুম্মা আমিন। তারপর নামাজ পাটি গুটিয়ে রেখে আরিফকে চিঠি লিখল।
প্রাণপ্রিয় আরিফ,
প্রথমে আমার শতকোটি সালাম নিয়ো। পরে প্রেম, প্রীতি ও ভালবাসা গ্রহণ করো। আর তোমার আব্বা-আম্মার পবিত্র কদমে আমার সালাম বলবে। তুমি দেশে যাবার পর তোমার স্মৃতির ব্যথা বুকে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিলাম; কিন্তু আজ এই মুহুর্ত থেকে ব্যথাটা অসহ্য যন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে। আমার কেবলই মনে হচ্ছে, তোমার কোন বিপদ হয়েছে। তাই আত্নহপাকের কাছে তোমার সহিসালামতের জন্য দোয়া চেয়ে থাকতে না পেরে এই পত্র লিখছি। তোমার যদি আসতে দেরি থাকে, তাহলে পত্র পাওয়া মাত্র পত্র দিয়ে জানাবে। নচেৎ আমি লজ্জার মাথা খেয়ে এসে পড়ব। তোমার কায় আমি খুব বেচায়েন হয়ে আছি। আর একবার তোমাকে প্রেম-প্রীতি ও ভালবাসা নিয়ে এবং আল্লাহ পাকের দরবারে তোমার সহিসালামতের জন্য দোয়া চেয়ে শেষ করছি।
তোমারই ফাল্গুনী
পরের দিন সকালে ফাল্গুনী নাস্তার টেবিলে পেপারে আহত আরিফের ছবি দেখে চমকে উঠল। তারপর ঘটনাটা পড়ে চোখের পানি রোধ করতে পারল না। পেপারটা আব্বার দিকে এগিয়ে দিয়ে ভিজে গলায় আতঙ্কিত স্বরে বলল, আরিফ দুতকারীদের হাতে আহত হয়ে হাসপাতালে আছে।