পরের দিন সকালে আরিফ সিরাজগঞ্জ রওয়ানা দিল। বিকেলে পৌঁছে সিরাজগঞ্জ টাউনে একটা হোটেলে থাকল। পরের দিন উকিলের চেম্বারে তার সঙ্গে দেখা করল।
সানোয়ার উকিল কাগজপত্র বের করে টেবিলের উপর রেখে বললেন, সবকিছু রেজী করে রেখেছি। পড়ে দেখে সই করুন। আপনি চাইলে, আজই রেজিষ্ট্রি করতে পান।
আরিফ সবকিছু পড়ে সই করে বলল, না আজ করব না। আমি আর একটা উইল করতে চাই। দুটো উইল একই দিনে রেজিস্ট্রি করব। সে জন্যে যদি দুএকদিন থাকতে হয় থাকব।
সানোয়ার উকিল কাগজ-কলম নিয়ে বললেন, বেশ তাই হবে, এখন বলুন কি উইল করতে চান। আমি খসড়া করে নিই।
আরিফ বলল, সমেশপুরে আমার ফুফা যে সব সম্পত্তি আমার নামে দলিল করে দিয়েছেন। সে সব আমি ফুফার চাচাতো ভাই সামসুর হেলে রফিকের নামে উইল করতে চাই। তবে আমার ফুফা-ফুষি মারা যাবার পর রফিক অধিকারী হবে। তার আগে
সানোয়ার উকিল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আপনার ফুফা-ফুফি তো তাদের সবকিছু আপনাকে দলিল করে দিয়েছেন। এখন আপনি সবকিছুর মালিক। ওঁদের। মৃত্যুর শত উল্লেখ করতে চাচ্ছেন কেন? ওদের তো এই সম্পত্তিতে কোন হক নেই?
সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, আপনাকে বলতে পারব না।
তাহলে আপনার ফুফা-ফুফির মৃত্যুর পর এই উইল করতে পারতেন।
তা পারতাম। কিন্তু কে কখন মরবে তা কি কেউ জানে? তাদের আগে আমিও তো মরে যেতে পারি?
সানোয়ার উকিল এই কথার কোন উত্তর দিতে না পেরে কিছুক্ষণ চুপ করে চিন্তা করলেন, তারপর বললেন, ঠিক আছে তাই হবে। আপনার ফুফা আপনার নামে যে উইল করিয়েছেন, তা আমিই করেছিলাম, তার খসড়া আমার ফাইলে আছে। সেটা দেখে দাগ নাম্বার ও খতিয়ান নাম্বার পেয়ে যাব। আজ-কালের মধ্যে আশা করি সবকিছু রেডী করতে পারব। পরদিন দুটো উইল এক সঙ্গে রেজি করাতে পারবেন।
আরিফ বলল, ঠিক আছে তাই হবে। আর ওনন, দুটো উইলের ব্যাপারটা খুব গোপন রাখবেন। ঘূণাক্ষরেও অন্য কেউ যেন জানতে না পারে।
সানোয়ার উকিল বললেন, এসব সম্বন্ধে আমাদেরকে কিছু বলা লাগবে না।
আরিফ বলল, আমি সিরাজগঞ্জে রেষ্ট হাউসে আছি। পরদিন এই সময়ে তাহলে আসব?
সানোয়ার উকিল বললেন, জ্বী আসবেন।
আরিফ সালাম বিনিময় করে উকিলের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে একজন মুখচেনা লোককে দুজন অচেনা এ ধরনের লোকের সঙ্গে কথা বলতে দেখে সেদিকে এগিয়ে এল।
আরিফকে তাদের দিকে আসতে দেখে অচেনা লোক দুটো সেখান থেকে চলে গেল।
আরিফ সেই মুখচেনা লোকটার কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, আপনার বাড়ি এনায়েতপুরে না?
লোকটা থতমত খেয়ে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, হ্যাঁ, কেন বলুন তো?
বলছি, তার আগে আপনার নাম বলুন।
আমার নাম জয়নাল। তারপর না চেনার ভান করে বলল, কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনতে পারছি না।
আমি আরিফ, সাজ্জাদের ছোট চাচা মরহুম জাকির হোসেনের ছেলে। আপনি আমার একটা উপকার করবেন?
জয়নাল মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। ম্যাট্রিক পাস করে আজেবাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশে খারাপ হয়ে গিয়েছিল। প্রথম জীবনে অনেক অকাজ-কুকাজ করেছে। এখন বিয়ে করে ছেলে-মেয়ের বাপ হয়েছে। চাষ-বাস করেই সংসার চালায়। কিন্তু অভাব-অনটনের মধ্যে দিন কাটায়। আরিফ যখন এলায়েতপুরে এসে কয়েকদিন ছিল তখন সাদ তাকে খুন করার জন্য জয়নালকে বেশ কিছু টাকা অফার করেছিল। কিন্তু জয়নাল আজি হয়নি। বলেছিল এখন ঐসব কাজ ছেড়ে দিয়েছি, আমার ছেলে-মেয়ে আছে। ঐ সব কাজ করলে তাদের ক্ষতি হবে। সেই সময় জয়নাল আরিফকে দেখলেও আরিফের সঙ্গে তার পরিচয় হয় নি। তাই সাজ্জাদ এবারে তার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলেছে, তোকে খুন করতে হবে না, শুধু প্রতিদিন সিরাজগয়ে কেটে গিয়ে লক্ষ্য রাখবি আরিফ এসেছে কিনা। এতে আমার দুজন লোক তোর সঙ্গে থাকবে, তাদেরকে চিনিয়ে দিবি। তখন জয়নালের বড় ছেলেটার খুব অসুখ। টাকার জন্য চিকিৎসা করাতে পারছিল না। অনিচ্ছা সত্তেও একরকম বাধ্য হয়ে তার কথায় রাজি হয়। প্রতিদিন কোর্টে এসে সাজ্জাদের দুজন লোকের সঙ্গে সারাদিন গল্প করে কাটায় আর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে। আজ আরিফকে সানোয়ার উকিলের চেম্বারের দিকে যেতে দেখে গুণ্ডা দুজনকে চিনিয়ে দিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলছিল। তারা আর একবার ভাল করে দেখার জন্য এবং তাকে ফলো করার জন্য সানোয়ার উকিলের চেম্বারের কিছুটা দূরে জয়নালের সাথে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল।
জয়নালের সঙ্গে আরিফের পরিচয় না হলেও সে যখন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াত তখন এনায়েতপুরে তাকে কয়েকবার দেখেছে। সে কথা জানান জানত না। এখন আরিফের কথা শুনে কি বলবে না বলবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে চুপ করে রইল।
আরিফ বলল, কি চিন্তা করছেন?
ঃ না মানে আমি গ্রামের চাষী মানুষ। আপনার কি এমন উপকার করতে পারব, বলুন?
তেমন কিছুই না, আপনি খালেক ও মালেককে চেনেন তো?
জী, চিনি।
আমি সিরাজগঞ্জে রেষ্ট হাউসের পনের নাম্বার রুমে আছি। অতি অবশ্য কাল তাদেরকে আমার কাছে আসতে বলবেন।
জয়নাল বলল, জী বলব।
আরিফ সালাম বিনিময় করে চলে গেল।
গুণ্ডা দুজন এতক্ষণ সরে গিয়ে আড়াল থেকে তাদেরকে লক্ষ্য রাখছিল।
আরিফ চলে যাবার পর একজন তাকে ফলো করল। আর একজন জয়নালের কাছে। এসে বলল, আরিফ সাহেব আপনাকে কি বললেন?