সাজ্জাদের কথামত গুণ্ডারা আরিফকে ফলো রাখল।
আরিফ সপ্তাহ খানেক পরে সানোয়ার উকিলের কাছে গিয়ে বলল, কতদূর কি করলেন?
সানোয়ার উকিল বললেন, কাগজপত্র এখনো সব জোগাড় করতে পারিনি। আপনি কয়েক দিন পরে আসুন।
আরিফ তাকে তাড়াতাড়ি করার জন্য তাগিদ দিয়ে ফিরে এল। চার পাঁচ দিন পর আবার সানোয়ার উকিলের কাছে গেল।
সানোয়ার উকিল বললেন, সাজ্জাদ খুব চালাক ছেলে। বাপ মারা যেতে না যেতে সেটেলমেন্ট অফিসে গিয়ে চাচা নিঃসন্তান জানিয়ে সব সম্পত্তি নিজের নামে লিখিয়েছে। কোর্ট থেকে সব কিছু নিজের নামে করার ব্যবস্থা করেছে।
আরিফ বলল, তাহলে তো কাজ সমাপ্ত করতে বেশ দেরি হবে?
সানোয়ার উকিল বললেন, হ্যাঁ তা হবে।
আরিফ তার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলল, এগুলো রাখুন। সবকিছু রেডী করে চিঠি দিয়ে জানাবেন। আমি আসব। তারপর সালাম বিনিময় করে বিদায় নিয়ে ফিরে এল।
সেদিন রাতে আরিফ নিহারবানুকে বলল, চাচী আম্মা, আমি কাল সকালে ঢাকা চলে যাব।
নিহারবার মনে যাই থাকুক না কেন, এই কয়েক দিন আরিফের বেশ আদর-যত্ন করেছেন। এখন তার কথা শুনে বললেন, আরো কয়েকদিন থাক না বাবা।
আরিফ বলল, না চাচী-আস্থা থাকতে পারব না। পড়াশুনার ক্ষতি হবে।
পরের দিন সকালে আরিফ চলে যাবার পর সাজ্জাদ মাকে বলল, আরিফ খুব চালাক। আমাদেরকে কিছু জিজ্ঞেস না করে বাপের সম্পত্তির কাগজপত্র কোট থেকে তোলার জন্য সিরাজগঞ্জে গিয়ে সানোয়ার উকিলকে ধরেছে। আমিও দেখব কেমন করে সে বাপের সম্পত্তি নিতে পারে।
নিহারবানু বললেন, তোর ফুফা-ফুফি তার পিছনে আছে। তাছাড়া গ্রামের লোকেরাও সব কিছু জানে।
সাজ্জাদ বলল, সেইজন্যেই তো ওকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছি।
আরিফ এনায়েতপুরে আসার দুদিন পর থেকে বুঝতে পেরেছিল, তাকে দুজন লোক সব সময় ফলো করে। তাই যে কয়েকদিন সেখানে ছিল, সব সময় সচেতন ছিল। আগেই ভেবে রেখেছে, প্রথমে সমেশপুরে গিয়ে মায়ের কবর জিয়ারত করবে তারপর ঢাকায় ফিরবে। এনায়েতপুর থেকে সিরাজগঞ্জে আসার সময় বাসে সেই দুজন লোককে দেখে ভাবল, এদেরকে উচিত মত শিক্ষা দিতে হবে। সমেশপুরে বাস থেকে নেমে রাস্তার পাশের টিউবঅয়েল থেকে অজু করে মায়ের কবর জিয়ারত করার জন্য কবরস্থানের দিকে রওয়ানা হল, মায়ের কবরের কাছে এসে প্রথমে সালাম দিল আসসালামু আলায়কুম ইয়া আহলাল কুবুরে মিনাল মোসলেমিনা, ওয়াল মোমনীনা, আওলানা সালাফেও ওয়া নাহনু লাকুম তাবাওও ওয়া ইন্না ইনশায়াল্লাহ বেকুম লা হেনা, ইয়ার হামলাহুল মুশতাকদেমীন, মিন্না ওয়াল মোমেনীনা, নাশরাহ লানা ওয়ালাকুম, ওয়া ইয়ারহামুল্লাহ ওয়া ইয়াকুম, আমীন, তারপর উনিশ বার বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, একবার সূরা তাকাসুর, একবার সূরা কোরাইশ, তিনবার সূরা এখলাস, একবার সূরা ফালাক, একবার সূরা নাস, একবার আয়তুল কুরসি, দশবার আসতাগফেরুহ ও অন্যান্য কিছু সুরা কেরাত এবং এগারবার দরুদ শরীফ পাঠ করে মায়ের রুহের উপর বখশে দিয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে অনেক কিছু বলে মোনাজাত করতে লাগল।
খালেক ও মালেক আরিফকে ফলো করে আসার সময় পরামর্শ করল, এখানে মেরে ফেলে রেখে গেলে কেউ আমাদেরকে সন্দেহ করতে পারবে না। তবে গুলি করে মারা ঠিক হবে না। কারণ গুলির শব্দ শুনে কেউ যদি এদিকে লক্ষ্য রাখে, তাহলে আমাদের দেখে ফেলতে পারে। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিল, ড্যাগার দিয়ে কাজ সারবে। তবে দরকার হলে গুলিও করবে। জলের ভিতর আরিফকে ঢুকতে দেখে প্রথমে তারা বেশ অবাক হলেও নিরাপদে কাজ সারতে পারবে ভেবে মনে মনে খুশি হল। তারপর এই জঙ্গলের ভিতর কবর ও আরিফের কার্যকলাপ দেখে খুব আশ্চর্য হয়ে বলাবলি করল, কবরটা কত সুন্দর। নিশ্চয় ওর আপনজনের। তারা আরিফের অনতিদুরে পাশাপাশি দুটো গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে যুক্তি করল, আরিফ যখন ফিরবে তখন দুজনে একসঙ্গে পিছন থেকে আক্রমণ করে শেষ করে দেবে।
আরিফ মোনাজাত শেষ করে কবরের দক্ষিণ দিকে বসে পড়ে কবরে মুখ ঠেকিয়ে কয়েক বার চুমু খেল, তারপর ফিরে আসতে লাগল। সে যখন অজ করে কবরস্থানের দিকে রওয়ানা দেয় তখন তার মনে মায়ের কথা ভেসে উঠে। ফলে তা দুজনের কথা ভুলে যায়। কবর জিয়ারত করে ফেরার সময় হঠাৎ তাদের কথা মনে পড়তে চিন্তা করল, তারা নিশ্চয় আমাকে ফলো করে এখানে এসেছে। তাই চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রেখে ফিরে আসতে লাগল। কিন্তু ততক্ষণে সে খালেক ও মালেক যেখানে লুকিয়েছিল, সেখান থেকে কিছুটা এগিয়ে এসেছে।
খালেক ও মালেক পা টিপে টিপে এসে পিছন থেকে আরিফকে ড্যাগার মারার জন্য হাত তুলল, কিন্তু তারা হাত আর নামাতে পারল না। তাদের মনে হল, কেউ যেন তাদের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। আরিফ যখন বেশ কিছুটা দূরে চলে গেল তখন তারা হাত নামাতে পারল। খুব অবাক হয়ে একজন অপরজনকে বলল, কি ব্যাপার বল তো, কেউ যেন এতক্ষণ আমার হাত ধরে রেখেছিল। অপরজন বলল, আমারও তাই। তারা তখন গুলি করে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে দুজন দুটো পিস্তল বের করে গুলি করতে যাবে এমন সময় দেখল আরিফ ঘুরে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে চেয়ে আছে।
আরিফ তাদের কথা বলার চাপা শব্দ শুনতে পেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। খালেক ও মালেক তার বুক অক্ষ্য করে ফায়ার করল। আরিফের বুকে যে দুটো তাবিজ ছিল গুলি সেগুলোর উপর লাগল। আরিফ গুলি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। কিন্তু বুঝতে পারল, তার কোন ক্ষতি হয়নি। হঠাৎ তার মনে হল নানার তাবিজের গুণে আল্লাহ পাক বাঁচিয়ে দিয়েছেন। তাবিজ দুটোতে চুমো খেয়ে আলাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করল। তারপর ক্রল করে লোক দুটোর পিছন দিকে যেতে লাগল।