যুবতীটি ধন্যবাদ জানিয়ে সাথীদের নিয়ে চলে গেল।
ঐ যুবতীটি ফাল্গুনী। সে তিন দিনের দিন সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আসে।
ফাল্গুনী যখন আরিফের সাহায্য করার কথা সব তার বাবাকে বলে তখন ইলিয়াস সাহেব বললেন, ছেলেটাকে আমি দেখেই বুঝতে পেরেছি, খুব বনেদী ঘরের।
তুই তার ঠিকানা জানিস?
ফাল্গুনী বলল, তার নাম আরিফ, দেশের বাড়ি সিরাজগঞ্জের সমেশপুর গ্রামে। ভাসিটিতে জুওলজিতে মাস্টার্স করছে। কিন্তু ঢাকার ঠিকানা জানার সময় পেলাম না। আজ ঠিকানা পেয়ে বাসায় এসে আব্বাকে বলল, আরিফ সাহেবের বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়েছি।
ইলিয়াস সাহেব বললেন, ঠিক আছে আমাকে মনে করিয়ে দিন, কয়েকদিন পরে হয় যাওয়া যাবে।
সাত আট দিন পর ফাল্গুনী আব্বাকে সঙ্গে নিয়ে একদিন বিকেলে আরিফের বাসায় গেল।
কলিংবেলের শব্দ পেয়ে গোফরান সাহেব ওমরকে বললেন, দেখ তো কে এল। ওমর দরজা খুলে আগন্তুকদের চিনতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, কাকে চান?
ইলিয়াস সাহেব বললেন, এখানে আরিফ সাহেব থাকেন?
জ্বী থাকেন।
তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
কিন্তু ছোট সাহেব তো এখনো দেশের বাড়ি থেকে ফেরেন নি।
বাসায় আর কে কে আছেন?
বড় সাহেব ও বেগম সাহেব আছেন।
আমরা তাদের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
ওমর কারো সঙ্গে কথা বলছে বুঝতে পেরে গোফরান সাহেব ভিতর থেকে বললেন, ওমর কে এসেছে রে?
ওমর বলল, একজন সাহেব আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে চান। সঙ্গে একজন মেয়েও আছে।
গোফরান সাহেব বললেন, ঠিক আছে ওঁদেরকে ড্রইংরুমে বসা, আমি আসছি।
ওমর আগন্তুকদের বলল, আপনারা ভিতরে এসে বসুন। তারপর ইলিয়াস সাহেব ও ফাল্গুনীকে ড্রইংরুমে এনে বসতে বলে ভিতরে চলে গেল।
একটু পরে গোফরান সাহেব ড্রইংরুমে এসে সালাম দিয়ে বসে বললেন, আপনাদের তো চিনতে পারলাম না।
ইলিয়াস সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আমরা তো পরিচিত লোক নই যে চিনবেন। আপনার ছেলের সঙ্গেও আমাদের তেমন পরিচয় নেই। কিন্তু তিনি আমাদের যা উপকার করেছেন, তা কোন দিন ভুলতে পারবো না। তাই আপনাদের সবার সঙ্গে পরিচিত হতে এলাম।
গোফরান সাহেব মৃদু হেসে বললেন, ছেলেটার স্বভাবই ঐরকম, তা আপনাদের কি এমন উপকার করেছে?
ইলিয়াস সাহেব মেয়েকে দেখিয়ে বললেন, এ আমার একমাত্র সন্তান। কয়েকদিন আগে এর কলেরার মত হয়েছিল। আমি সে সময় রাজশাহী গিয়েছিলাম। তারপর আরিফ দুদিন কিভাবে তার মেয়েকে সাহায্য করেছিল, সে সব বলে বললেন, ঐ দিন আপনার ছেলে সাহায্য না করলে আমার মেয়ে হয়তো মারাই যেত। তিনি আমাকে টেলিফোন করে খবরটা দেন। আমি আসার পর পর হাসপাতাল থেকে চলে আসেন। পরিচয় নেবার সময়টুকু পর্যন্ত আমাকে দেননি।
গোফরান সাহেব বললেন, সে তো নেই। কয়েকদিন আগে দেশের বাড়ীতে গেছে। তাড়াতাড়ি ফেরার কথা ছিল। আজই তার চিঠি পেলাম, লিখেছে ফিরতে আরো কয়েক দিন দেরি হবে। ইলিয়াস সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে ফাল্গুনীর অপূর্ব রূপলাবণ্য দেখে গোফরান সাহেব খুব অবাক হলেন। তার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি মা?
আসমা বিনতে ইলিয়াস, ডাক নাম ফাল্গুনী।
সুবহান আল্লাহ, দুটো নামই খুব সুন্দর।
নিশ্চয় পড়াবনা করছ?
জী বাংলায় অনার্স করছি।
আলহামদুলিল্লাহ।
এমন সময় ওমর দুজনের নাস্তা নিয়ে এসে টেবিলের উপর রেখে ফাল্গুনীর দিকে চেয়ে বলল, উনাকে বেগম সাহেব ভিতরে যেতে বলেছেন।
সুফিয়া বেগম স্বামীর সঙ্গে এসে দরজার পর্দা ফাঁক করে তাদের কথাবার্তা শুনছিলেন। ফাল্গুনীকে দেখে উনিও খুব অবাক হয়েছেন। তাই তাকে ভিতরে ডেকে পাঠিয়েছেন।
ওমরের কথা শুনে বাপ-বেটিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে দেখে গোফরান সাহেবের মুখে হাসি ফুটে উঠল। ফাল্গুনীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, যাও মা ভিতরে যাও, আরিফের আম্মা তোমাকে ডাকছে।
মেয়েকে ইতস্তত করতে দেখে ইলিয়াস সাহেব বললেন, বসে আছিস কেন যা।
ফাল্গুনী ওমরের সাথে পর্দা ঠেলে পাশের রুমে ঢুকে দেখল, একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। তার মনে হলো ইনিই আরিফ সাহেবের মা। সালাম দিয়ে কদমবুসি করতে গেলে সুফিয়া বেগম সালামের উত্তর দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, থাক মা থাক, কদমবুসি করতে হবে না। তারপর দোওয়া করে আনোয়ারাকে নাস্তা নিয়ে আসতে বলে ফাল্গুনীকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সঙ্গে কি আরিফের আগের থেকে পরিচয় ছিল?
ঃ জ্বী না, আমাকে আমাদের কাজের মেয়ে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, তার মুখে শুনেছি আরিফ সাহেব আগের থেকে হাসপাতালের গেটের কাছে ছিলেন।
ঃ তোমার আম্মা নেই?
জ্বী না, আমার বয়স যখন দশ বছর তখন আম্মা মারা যান
তোমাদের দেশের বাড়ি কোথায়?
রাজশাহী।
ততক্ষণে ফাল্গুনীর খাওয়া শেষ হয়েছে। বলল, এবার আসি খালা আম্মা।
সুফিয়া বেগম ফাল্গুনীর চিবুক ধরে তার দুগালে চুমো খেয়ে বললেন, আমার মেয়ে নেই, তোমারও মা নেই। আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে। যখনই ইচ্ছা হবে মাকে দেখতে চলে আসবে।
সুফিয়া বেগমের আদর-সোহাগে ফাল্গুনীর চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল, তখন তার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ল। মা তাকে কত ভালবাসত। যখন মা মারা যায় তখন তার বয়স দশ বছর হলেও মায়ের মুখের ছবি বেশ মনে আছে।