আরিফ প্রথম দিন সাজ্জাদের সঙ্গে পরিচয় হবার সময় তার মুখের দিকে চেয়ে যা বুঝতে পেরেছিল, পরের দিন সকাল থেকে তার বিপরীত দেখে বিপদের গন্ধ পেল। তার মনে হল, এত খাতির-যত্নের পিছনে নিশ্চয় কোন কুমতলব আছে। তখন তার আব্বার কথা মনে পড়ল, খুব সাবধানে থাকবে। এখানে এসে কি করবে, তা সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছে। তাই পরের দিন আব্বার কবর জিয়ারত করল। তার পর গ্রামের সবার সঙ্গে পরিচিত হতে লাগল। দু তিন দিন পর উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য কাউকে কিছু না বলে সিরাজগঞ্জ কোর্টে গেল। সানোয়ার একজন নামকরা উকিল। আরিফ লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে তার কাছে গিয়ে নিজের ইচ্ছার কথা বলল।
সানোয়ার উকিলের বাড়ি এনায়েতপুরে। টাউনে বাড়ি করে ফ্যামিলী নিয়ে থাকেন। তিনি আরিফের বাপ-চাচাদের চিনেন। গোফরান সাহেবকেও চিনেন। আরিফের কথা শুনে বললেন, আপনি জাকিরের উপযুক্ত সন্তান। আপনার নানা-নানী ও মায়ের সঙ্গে অনেক কিংবদন্তি আছে। আপনি কি সেসব জানেন?
আরিফ বলল, কিছু কিছু জানি। ওসব কথা থাক। আমি আপনাকে যা কিছু বললাম, সেগুলো একটু তাড়াতাড়ি করবেন। আমাকে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ঢালয় ফিরতে হবে। সামনে আমার পরীক্ষা। আর শুনুন। একথা আপনি কাউকে জানাবেন
সানোয়ার উকিল বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না আমি সবকিছু তৈরি করে আপনাকে খবর দেব। আপনি এসে রেজি িকরে দেবেন। দুএকদিনের মধ্যে পারতাম, কিন্তু আপনি তো কোন দলিলপত্র দিতে পারছেন না। তাই সেগুলো কোর্ট থেকে তুলতে সময় লাগবে।
আরিফ তাকে বেশ কিছু টাকা দিয়ে ফিরে এল।
সাজ্জাদ যে দুজন গুপ্তাকে ঠিক করেছিল তাদের নাম খালেক ও মালেক। আরিফ আসার পরের দিন শুণ্ডা দুজনকে তাকে চিনিয়ে দিয়ে বলেছিল, আরিফ একা গ্রামের বাইরে কোথাও গেলে সুযোগ মত মেরে গুম করে দিবি। তারপর দশ হাজার টাকা দিয়ে বলল, অর্ধেক দিলাম বাকিটা কাজ হাসিল করার পর পাবি। কিন্তু খুব সাবধান, কেউ যেন টের না পায়। সেই থেকে তারা আরিফকে চোখে চোখে রেখেছে।
আজ আরিফ যখন সিরাজগঞ্জ কোর্টে যায় তখন তারাও পিছু নেয়। ফেরার সময়ও তার সঙ্গে ছিল। কিন্তু মার্ডার করার কোন সুযোগ পেল না। আরিফের ফিরতে বিকেল হয়ে গেল।
নিহারবানু অনুযোগসুরে বললেন, সারাদিন না খেয়ে কোথায় ছিলে বাবা? খাওয়া দাওয়া ঠিকমত না করলে অসুখ-বিসুখ করবে। তখন তো সুফিয়া বুবু ও গোফরান ভাই আমাকে দোষ দিবে।
আরিফ বলল, সিরাজগঞ্জে একটা কাজে গিয়েছিলাম।
নিহারবানু বললেন, সে কথা বলে যেতে পারতে বাবা। দিনকাল ভাল নয়, সাজ্জাদ হয় তোমার সাথে যেত। আর কোন দিন একা একা কোথাও যেও না। তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে এস, খেতে দেব। সাজ্জাদ তোমার জন্য অপেক্ষা করে এই কিছুক্ষণ আগে যেয়ে আড়তে গেল।
আরিফ খেয়ে উঠে বাবা মাকে চিঠি লিখে জানাল, তার ফিরতে হয়তো দশবার দিন দেরি হবে। সে জন্য কোনরকম দুশ্চিন্তা যেন না করে।
এদিকে সুফিয়া বেগম আরিফের ফিরতে দেরি দেখে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। স্বামীকে বললেন, আমরাও যাই চল।
গোফরান সাহেব বললেন, আরিফ তো বলে গেল, ফিরতে দেরি হলে আমরা যেন চিন্তা না করি।
কিন্তু আমার মনে বোধ নিচ্ছে না। কেবলই মনে হচ্ছে, সে কোন বিপদে পড়েছে। আমাকে না হয় বাড়িতে রেখে তুমি এনায়েতপুরে যাবে।
তুমি মা, মায়েরা সন্তানের বিপদের কথা বেশি ভাবে। আমি বাপ আমরাও ভাবি; তবে বাপেরা মায়েদের মত অত উতলা হয় না। আরিফ এক সপ্তাহের কথা বলে গেছে, আরো দুএকদিন দেখব; এর মধ্যে না ফিরলে তুমি যা বললে তাই করব।
আরিফ যাবার দুতিন দিন পর আবার তার খোঁজে এল।
গোফরান সাহেব ও সুফিয়া বেগম তাকে চেনেন। আপ্যায়ন করবার পর বললেন, আরিফ দেশের বাড়ি গেছে, সপ্তাহ খানেক পরে ফিরবে।
আবসার কয়েক দিন পরে আসবে বলে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রিল্লা করে ফিরে আসছিল। নিউ এলিফেন্ট রোডের জুতোর দোকানগুলোর সামনে থেকে আসার সময় রীমার কথা মনে পড়ল। সে কয়েক দিন থেকে এক জোড়া স্যান্ডেল কেনার কথা বলছে, ঘোড়ার ডিম মনেই থাকে না। রিক্সাওয়ালাকে বলল, এই ভাই দাঁড়াও তো। রিক্সাওয়ালা রিক্সা থামাবার পর বলল, তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি একজোড়া স্যাভেল কিনব। অবশ্য, এর জন্য ভাড়া বেশি দেব।
রিক্সাওয়ালা বলল, একটু তাড়াতাড়ি করবেন সাহেব।
আবসার একটা দোকানে ঢুকে দেখল সেখানে কয়েক জন যুবতী জুতো কিনছে। সে একজন সেলসম্যানকে একজোড়া লেডিস স্যান্ডেল দেখাতে বলল।
ততক্ষণে যুবতীরা জুতো কিনে বেরোতে যাবে এমন সময় তাদের মধ্যে একজন আবসারের দিকে চেয়ে বলল, কিছু মনে করবেন না, আপনাকে মহাখালী কলেরা হাসপাতালে দেখেছিলাম। আপনি আরিফ সাহেবের বন্ধু না?
আবসার প্রথমে তাকে চিনতে পারল না। কারণ আজ তার মাথায় কালো রুমাল বাঁধা। গায়ে কালো রংয়ের বড় চাদর জড়ানো। তার দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে চিনতে পেরে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, যা আপনি ঠিক বলেছেন।
ঃ আমি বাইরে অপেক্ষা করছি, আপনি কাজ সেরে আসুন, কথা আছে।
আবসার জুতো কিনে দোকানের বাইরে এলে সেই যুবতীটি বলল, আরিফ সাহেবের ঠিকানাটা দেবেন?
আবসার একটা কাগজে ঠিকানা লিখে তার হাতে দিয়ে বলল, আমি এখন তার বাসা থেকে ফিরছি। সে দেশের বাড়িতে গেছে। সপ্তাহ খানেক পরে ফিরবে।