ইমাম সাহেব বললেন, আরিফ ঢাকা থেকে এসেছে বাড়িতে নিয়ে যাও। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা কর।
সাজ্জাদ মনে মনে রেগে গেলেও তা প্রকাশ না করে আরিফকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে এল। তারপর মাকে খবরটা জানাল।
নিহারবানুও শুনে চমকে উঠলেন। হঠাৎ খবর না দিয়ে আরিফ আসবে তিনি যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। বললেন, তাকে কোথায় বসিয়েছিস?
সাজ্জাদ বলল, বৈঠকখানায়।
নিহারবানু বললেন, যা তাকে নিয়ে আয়। আমি ওর মায়ের রুম খুলে দিচ্ছি। সাজ্জাদ চলে যাবার পর নিহারবানু ছোট জায়ের ঘর খুলে সুইচ টিপে খুব অবাক হয়ে গেলেন। আরিফের বাবা জাকির মারা যাবার পর থেকে ঐ ঘর চাবি দেওয়া আছে। নিহারবানু নিজে ঐ ঘরে থাকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু থাকতে পারেননি। স্বামীর নিষেধ সত্ত্বেও নিহারবানু যখন একরাতে ঐ ঘরে সাজ্জাদকে নিয়ে ঘুমাতে গেলেন, কিন্তু ঘুমাতে পারেননি। চোখ বন্ধ করলেই যেন মনে হয়, সাদিয়া ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করছে। তখন এনায়েতপুরে কারেন্ট যায়নি। হারিকেন জেলেই শুয়ে ছিলেন। সাদিয়া হাঁটাহাঁটি করছে মনে হলে চেয়ে দেখেছেন, কিন্তু তাকে দেখতে পাননি। শেষে ভয় পেয়ে সাজ্জাদকে নিয়ে নিজের রুমে চলে আসেন। তারপর থেকে সেই যে চাবি দিয়ে রেখেছিলেন এত বছর আর খুলেননি। আজ খুলে দেখলেন, সব কিছু পরিপাটি। এতটুকু ধুলো পর্যন্ত বিছানায় বা অন্য আসবাবপত্রে পড়েনি। আরিফের বাবা ও মায়ের কাপড় চোপড় আলনায় যেমন গোছান ছিল, ঠিক তেমনি রয়েছে, সেগুলোতেও কোন ধুলো বালি নেই। মনে হয় যেন একটু আগে কেউ ঘরটা ঝেড়েকুড়ে পরিষ্কার করেছে। আগের মতই ঘর থেকে আতর গোলাপের খবুই বেরোচ্ছে। সাজ্জাদের সঙ্গে আরিফকে আসতে দেখে দরজা থেকে পাশে সরে তার দিকে চেয়ে রইলেন। বাপের মতন আরিফের মুখের গড়ন হলেও রংটা মায়ের মত সাদা ধবধবে। এত সুন্দর ছেলে নিহারবানু আর দেখেননি। হঠাৎ তার মনে পড়ল, একেই ছোট বেলায় বিষ খাইয়ে এবং গলা টিপে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম।
সাজ্জাদ মায়ের কাছে এসে আরিফকে উদ্দেশ্য করে বলল, ইনি আমার মা।
আরিফ নিহারবানুকে কদমবুসি করে বলল, কেমন আছেন চাচী আম্মা?
নিহারবানু তার মাথায় হাত বুলিয়ে চুমো খেয়ে বললেন, বেঁচে থাক বাবা, আল্লাহ তোমাকে বাঁচিয়ে রাখুক। তুমি ভাল আছ বাবা?
আরিফ বলল, জী ভাল আছি।
নিহারবানু বললেন, তোমার ফুফু-ফুফা ভাল আছে? তারা এল না কেন?
আরিফ বলল, জী ভাল আছে। তারা পরে সময় করে আসবে।
নিহারবান বললেন, তুমি যদি কিছুদিন আগে আসতে বাবা, তাহলে তোমার চাচা তোমাকে দেখে শান্তিতে মরতে পারত। মারা যাবার আগে পর্যন্ত তোমাকে দেখতে চেয়েছিল।
আরিফ বলল, সব কিছু আল্লাহ পাকের ইশারা।
নিহারবানু বললেন, এটা তোমার মা-বাবার ঘর। তুমি ভিতরে গিয়ে বস, আমি তোমার খাবার ব্যবস্থা করি। তারপর সাজ্জাদকে নিয়ে চলে গেলেন।
আরিফ ঘরের ভিতরে ঢুকে মনের মধ্যে এক ধরনের শান্তি অনুভব করল। তার মনে হল, সে যেন তার মায়ের কোলে এল। মায়ের কথা তার মনে নেই। আতর গোলাপের খশরুই পেয়ে ভাবল, এই খুশবুইয়ের উৎস কোথায়? ঘরের চারপাশে তাকিয়ে কিছুই বুঝতে পারল না। অনেছে তার মা পরী ছিল ডাবল পরীর সঙ্গে কি মানুষের বিয়ে হয়? আবার ভাবল, হয়তো হবে। আল্লাহ পাকের কুদরত মানুষের বোঝার অসাধ্য। পরীরা খুব সুন্দরী হয়। তাহলে তার মাও নিশ্চয় খুব সুন্দরী ছিল। এই সব ভাবতে ভাবতে এক সময় তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।
কয়েক মাস আগে রফিক যখন এনায়েতপুরে আরিফের খোঁজ নিতে এসেছিল তখন খলিল সাহেব আরিফকে গোপনে আসার জন্য রফিককে বলেছিলেন, সে কথা নিহারবান এনেছিলেন। রফিক চলে যাবার পর ছেলেকে সে কথা জানিয়ে তার সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন, আরিফ এলে মেরে গুম করে ফেলা হবে।
সাজ্জাদ মায়ের মত কুটিল হয়েছে। সেও তাই চায়। সে জন্যে বাজারের দুজন ওকে হাত করে রেখেছে।
আজ নিহারবানু আরিফকে তার মায়ের ঘরে রেখে সাজ্জাদকে নিয়ে রান্না ঘরে এসে বললেন, শক্ত হাতের মুঠোয় এসেছে। এই সুযোগ আর পাবি না। কি করে কি করবি, ঠিক করে রেখেছিস তো?
সাজ্জাদ বলল, হ্যাঁ ঠিক করে রেখেছিলাম, কিন্তু সে প্ল্যান করা যাবে না। আরিফ যে এসেছে তা মসজিদের ইমাম ও খাদেম জানে। তাই ভেবেছি, এখানে কিছু করা ঠিক হবে না। মনে হয়, এসেছে যখন তখন হয়তো দুচারদিন থাকবে। এর মধ্যে বাইরে নিয়ে গিয়ে কাজটা করতে হবে। আমরা সেই সুযোগের অপেক্ষায় থাকবো।
নিহারবানু বললেন, যা কিছু করবি, খুব সাবধানে করবি। আর শোন, আরিফের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতে হবে। সে তোর ছোট হলেও তোর চেয়ে অনেক বেশি লেখাপড়া করেছে। তুই-তোকারি করে কথা বলবি না। মোট কথা এমন ব্যবহার দেখাতে হবে সে যেন বুঝতে না পারে তার প্রতি আমরা অসন্তুষ্ট। একটা কথা মনে রাখবি, সে এখানকার প্রায় সবকিছুর এখন মালিক। তোর আব্বার আর কতটুকু আছে।
সাজ্জাদ বলল, তোমাকে আর বেশি কিছু বলতে হবে না। যা যা বললে সেই মত করব।
সে রাতে আরিফ ঘুমাতে পারল না। সারারাত নফল নামাজ ও কোরান তেলাওয়াত করে আব্বা-আম্মার রুহের মাগফেরাতের জন্য দোয়া চাইল।
পরের দিন সাজ্জাদ আরিফকে তার বিষয় সম্পত্তি ও ব্যবসাপত্র দেখিয়ে বেড়াল। ধান চাল ও পাটের আড়তের কর্মচারীরা আরিফের পরিচয় পেয়ে খুব আনন্দিত।