সুফিয়া বেগম অভিমান করে বললেন, এ রকম ভুল করা তোমার ঠিক হয়নি। যাই হোক তোমাকে আর চিঠি লিখতে হবে না। আগামী কাল ঢাকা যাবার ব্যবস্থা কর। আমিও তোমার সঙ্গে যায়। সেখানেই তার গলায় তাবিজটা পরিয়ে দেব।
গোফরান সাহেব এর কথার কোন প্রতিবাদ করতে পারলেন না। তবে সংসারে কাজের কথা বলে এক সপ্তাহ পরে রওয়ানা দিলেন। সহে ওমরের বৌ আনোয়ারাকেও নিলেন।
আরিফ বাসাতেই ছিল। তাদেরকে দেখে আগের মত খুশি হতে পারল না। তবু সালাম ও কুশলাদি বিনিময় করে কদমবুসি করল।
ছেলের পরিবর্তন এদের চোখ এড়াল না। সুফিয়া বেগম গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে জিএস করলেন, তোর কি হয়েছে বাবা? তোকে যেন কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে।
আরিফ গম্ভীর মুখেই বলল, কিছু একটা হয়েছে, তবে সেটা ঠিক আমি বুঝতে পারছি না।
ঃ নিশ্চয় খাওয়া-দাওয়া ও ঘুমের অনিয়ম করেছিস?
ঃ না আম্মা, ওসব কিছু নয়, এখন তোমরা বিশ্রাম নাও, পরে বলব। এমন সময় মাগরিবের আযান শুনে বলল, আমি মসজিদে যাচ্ছি। তারপর সে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।
গোফরান সাহেব ওমরকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কিছু জানিস?
ওমর বলল, ছোট সাহেব দুদিন ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করেননি। এক রাত্রে বাসায়ও ছিলেন না। আজ একটা চিঠি এসেছে। চিঠি পড়ার পর আরিফ তাকে যা কিছু বলেছে সব বলল।
গোফরান সাহেব বললেন, ঠিক আছে, তুই আমাদের অজুর পানি দিয়ে নামাজ পড়তে যা।
মাগরিবের নামাজের পর সবাই যখন একসঙ্গে চা-নাস্তা খাচ্ছিল তখন সুফিয়া বেগম আরিফকে বললেন, এবার বলতো বাবা তোর কি হয়েছে?
আরিফ কয়েক সেকেও চুপ করে থেকে বলল, আমি এমন কিছু কথা জানতে পেরেছি, যেগুলো তোমরা আমার কাছে গোপন রেখেই।
সুফিয়া বেগম ছলছল নয়নে বললেন, তুই কি আমাদেরকে অবিশ্বাস করিস?
আরিফ বলল, অবিশ্বাস করার প্রশ্নই উঠে না। আমি শুধু জানতে চাই, তোমরা আমার কাছে কিছু গোপন করেছ কি না?
সুফিয়া বেগম কিছু বলার আগে গোফরান সাহে র ধরে বললেন, আজ আমরা খুব ক্লান্ত। এ ব্যাপারে কাল তোমার সাথে কথা বলব।
আরিফ আর কোন কথা না বলে নিজের রুমে চলে গেল।
খাওয়া-দাওয়ার পর সুফিয়া বেগম দুধের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে আরিফকে খাইয়ে নিজেরা জেগে রইলেন।
রাত একটার সময় গোফরান সাহেব ও সুফিয়া বেগম নেসার ফকিরের কথামত তাজিবটা আরিফের গলায় আগের তাবিজের সঙ্গে বেধে দিলেন।
সকালে আরিফ মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ পড়ে এসে পড়তে বসল।
বেলা আটটার সময় ওমর এসে বলল, বেগম সাহেব আপনাকে নাস্তা খেতে
আরিফ পড়া বন্ধ করে এসে মা-বাবার সঙ্গে নাস্তা খেতে লাগল।
গোফরান সাহেব ও সুফিয়া বেগম ছেলের মুখের দিকে চেয়ে বুঝতে পারলেন, গতকালের চেয়ে আজ তাকে বেশ স্বাভাবিক দেখাচ্ছে।
নাস্তা খাওয়ার পর গোফরান সাহেব আরিফকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি গতকাল যে কথা জানতে চেয়েছিলে, তা এখন বলব। তুমি উচ্চ শিক্ষা নিচ্ছ, ভালমন্দ বোঝার জ্ঞানও তোমার হয়েছে। যা বলব তা শুনে উত্তেজিত না হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করবে। যার কাছ থেকে যা কিছু শুনে থাক না কেন, সেগুলো সব সত্য নাও হতে পারে। আমাদের কথাগুলো সত্য জানবে। তারপর তার মা-বাবা, নানা-নানী ও চাচা চাচীর এবং যখন থেকে তাকে নিয়ে এসেছে সবকিছু বললেন। আরো বললেন, রফিকের বাবা সামসুর কুমতলবের কথা। সে তোমাকে ছোট বেলায় গলা টিপে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। সেই জন্য আমরা তোমাকে তার ছেলে রফিকের সনে মিশতে নিষেধ করেছিলাম। এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছ, আমরা তোমার ফুফা-ফুফি? তোমার মা মারা যাবার পর তোমার নানা নেসার ফকির যে রাতে আমাদের গ্রাম থেকে তোমার নানীকে নিয়ে চলে যান, সে রাতে যাবার আগে তোমার ব্যাপারে যা-যা করতে বলেছিলেন, আমরা সে সব পালন করেছি। নিজেদের ইমত কিছু করিনি। আমাদের কোন সন্তান নেই বলে শুধু তোমাকে ছেলে করে নিয়েছি। তুমি বড় হয়ে নিজের পরিচয় জানতে না চাওয়া পর্যন্ত তোমাকে জানাতে তোমার নানার নিষেধ ছিল। তাই এতদিন না জানিয়ে এখন জানালাম। তারপর গোফরান সাহেব চুপ করে গেলেন।
আরিফ নিজের পরিচয় শুনতে শুনতে চোখের পানিতে বুক ভাসাচ্ছিল। গোফরান সাহেব থেমে যেতে উঠে এসে তাদেরকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার আব্বা-আম্মাকে আরাহপাক দুনিয়া থেকে তুলে নিয়েছেন। তোমাদেরকেই আমি আব্বা-আম্মা বলে জানি, আর চিরকাল তাই জানব। আমাকে তোমরা দূরে সরিয়ে দিয়ো না।
সুফিয়া বেগম আরিফকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, এরকম কথা বলতে পারলি? দূরে সরিয়ে দেবার জন্য কি তোকে তোর সাড়ে তিন বছর বয়স থেকে লালন-পালন করে আসছি? তুই আমার পেটে না হলেও পেটের ছেলের মত তোকে মানুষ করেছি। তোকে ছাড়া আমরা বাঁচব কি করে। তোর ফুফা তার সমস্ত সম্পত্তি তোর নামে উইল করে দিয়েছে। তাই তো রফিকের আব্বা আমাদের সবার দুশমন। কিছুদিন আগে যেদিন তোর ফুফা উইল করার জন্য সিরাজগঞ্জ কোর্টে যাচ্ছিল তখন রফিকের আব্বা গুণ্ডা লাগিয়ে তাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। আল্লাহপাকের অসীম দয়ায় কিছু করতে পারেনি।
এই কথা শুনে আরিফ কান্না থামিয়ে ফুফাঁকে বলল, তুমি এর কোন প্রতিকার করনি?
গোফরান সাহেব বলল, আমি কোন ঝামেলায় যেতে চাইনি। আল্লাহপাকের বিচার আল্লাহপাকই করবেন। আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। ক্ষমাকারীকে আলাহপাক খুব ভালবাসেন। এটা কোরআন-হাদিসের কথা।