আরিফ হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আবসারের বাসায় গেল। খায়ের সাহেবের সঙ্গে দেখা করে চলে আসতে চাইলে আবসার বলল, সে কিরে কিছু না খেয়ে চলে যাবি?
রীমাও সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, আরিফ ভাই বসুন, চা-নাস্তা খেয়ে যাবেন, কথা আছে।
আরিফ আর আপত্তি করল না।
কিছুক্ষণের মধ্যে রীমা চা-নাস্তা নিয়ে এসে পরিবেশন করে, আরিফকে জিজ্ঞেস হলে, আপনার সেই রুগিনীর খবর কি?
আরিফ বলল, ভাল আছেন।
তার সঙ্গে কিছু কথাবার্তা হয়েছে নিশ্চয়?
হওয়া তো স্বাভাবিক।
আবসার বলল, হ্যারে তার বাবার খবর কি?
আমি হাসপাতালে থাকতেই উনি এসেছেন।
ও তার সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে নিশ্চয়?
তা হয়েছে। ভদ্রলোককে বেশ ধার্মিক মনে হল।
রীমা মৃদু হেসে বলল, তাহলে তো ভালই।
আরিফ একটু অবাক হয়ে বলল, তার মানে?
মানে আবার কি? বাবা ধার্মিক হলে, মেয়েও ধার্মিক হবে। আপনার সঙ্গে বনবে ভাল।
আরিফ লজ্জা পেয়ে বলল, ভাবি যে কি
কি আবার, সত্যি করে বলুন তো, মেয়েটা পছন্দ করার মত কিনা?
ভাবি আপনি কিন্তু অন্য সেন্সে কথা বলছেন।
আবসার বলল, তুই মেয়েটার জন্যে অনেক করেছিস। সে জন্যে তোর কাছে সে ঋণী।
আরিফ বলল, কি আর করেছি, তার জায়গায় অন্য কেউ হলেও করতাম। এটাই মানব ধর্ম। যাক এখন আসি। তারপর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এল।
পরের দিন আরিফ একটা চিঠি পেল। চিঠিটা রফিক দিয়েছে। বেশ অবাক হয়ে খুলে পড়তে লাগল
আরিফ, আজ সাত আট বছর আমাদের দুজনের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু ছোট বেলা থেকে আমরা দুজনে একবৃন্তে দুটো ফুলের মত জীবন কাটিয়েছি। তোকে তোর আসল পরিচয় বলার পর থেকে তুই আমার সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দিলি। কারণটা জানতে চাই না। তবে একটা অনুরোধ করছি, সে দিন তোকে যে তোর আসল পরিচয় বলেছিলাম, মনে হয় তুই তা বিশ্বাস করিস নি। কিন্তু আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি তা সব সত্য। তুই ই করলে এনায়েতপুরে গিয়ে তার বড় চাচার সঙ্গে দেখা করে সত্য মিথ্যা যাচাই করতে পারিস। তার নাম খলিল। তোর আব্বা ব্যবসা করে অনেক বিষয়-সম্পত্তি করেছি। সেই সব সম্পত্তি ও ব্যবসা তোর বড় চাচা ভোগ করছেন। তিনি খুব ভাল মানুষ। আমি বেশ কিছু দিন আগে তার সঙ্গে দেখা করে তোর আসল পরিচয় বলে সত্য। মিথ্যা জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি চোখের পানি ফেলতে ফেলতে স্বীকার করে বললেন, তোর ফুফা-ফুফির (গোফরান চাচা ও তার স্ত্রীর) কোন ছেলে মেয়ে হয়নি। তাদের অনুরোধে তিনি তোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। তবে তার ছেলেটার আচার-ব্যবহার তেমন ভাল নয়। তোর বড় চাচা খুব কঠিন অসুখে ভুগছে। মনে হয় বেশি দিন বাঁচবে না। আমি গোফরান চাচার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে শুনে বললেন আরিফকে মরবার আগে একবার দেখতে চাই। আর তার বাপের বিষয়-সম্পত্তিও বুঝিয়ে দিতে চাই। তাকে বলল সে যেন তাড়াতাড়ি আমাকে একবার দেখতে আসে। তুই উচ্চ শিক্ষা নিসি শুনে তোকে কত দোওয়া করলেন। এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছিস, কেন এত বছর পরে তোকে চিঠি লিখলাম। আশা করি তুই তোর চাচাকে দেখা দিয়ে তার শেষ ইচ্ছা পূরণ করবি। আর বিশেষ কি লিখব।
ইতি
রফিক
চিঠি পড়ে আরিফের মনের মধ্যে ঝড় উঠল। চিন্তা করল, হয়তো রফিক সত্যি কথাই জানিয়েছে। সিদ্ধান্ত নিল দুএকদিনের মধ্যে এনায়েতপুর যাবে। ওমরকে ডেকে বলল, আমি কাল সকালে ঢাকার বাইরে যাব। ফিরতে দুচারদিন দেরি হতে পারে। তুমি চিন্তা করো না।
ওমর বলল, আমাকে সঙ্গে নেবেন না?
না, আমি একাই যাব।
কিন্তু আপনার আব্বা-আম্মার হুকুম… কথাটা সে শেষ করতে পারল না। আরিফের চোখের দিকে চেয়ে থেমে গেল। তার চোখ দুটো দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে পড়ছে।
আরিফ গম্ভীর স্বরে বলল, আব্বা-আম্মার মত তুমিও আমার কাছে অনেক কিছু গোপন করেছ। এবার আমি নিজেই সেই গোপনতত্ত্ব আবিষ্কার করব।
ওমর তার হাতে চিঠি দেখে ভাবল, চিঠি পড়ে হয়তো তার মন খারাপ হয়েছে। ভয়ে সে কথা জিজ্ঞেস করতে পারল না। কাচুমাচু হয়ে বলল, আপনি ওরকম করে চেয়ে রয়েছেন কেন? আর গোপন করার কথা কি বলছেন, আমি তো কিছু বুঝতে পারছি।
আরিফ দৃষ্টি সংযত করে ভিজে গলায় বলল, কেউ বুঝেও না বুঝার ভান করলে তাকে বুঝা যায় না। অবশ্য এতে তোমার কোন দোষ নেই। ঠিক আছে, তুমি এখন যাও।
খোদার কি সান, ঐ দিন সন্ধের আগে গোফরান সাহেব ও সুফিয়া বেগম এসে, গেলেন।
গত মাসে আরিফের পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়েছে। সুফিয়া বেগম স্বামীকে সে কথা জানিয়ে আরিফের গলায় আর একটা তাবিজ বাধার কথা বলে তাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি আসার জন্য চিঠি দিতে বলেন।
গোফরান সাহেব বললেন, এত তাড়াহুড়া করছ কেন? ও এখন পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। তা ছাড়া নেসার ফকির তো বলেছিল, আরিফ নিজের পরিচয় জানতে চাওয়ার পর গলায় তাবিজ বাঁধতে।
সুফিয়া বেগম বললেন, তবু আমি বাঁধতে চাই আমাদের কাছ থেকে জানার আগে যদি আরিফ কারো কাছ থেকে জেনে গিয়ে আমাদেরকে কিছু জিজ্ঞেস করে তখন কি করবে?
গোফরান সাহেব বললেন, ঠিক আছে, আমি তাকে বাড়ি আসার জন্য চিঠি দিচ্ছি।
পনের-বিশদিন পার হয়ে যাবার পরও যখন আরিফ এল না, তখন একদিন সফিয়া বেগম স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার চিঠি পেয়েও আরিফ আসছে না কেন?
গোফরান সাহেব তখন স্ত্রীর কাছে চিঠি দেবার কথা বললেও সংসারের কাজের চাপে সে কথা একদম ভুলে গেছেন। বললেন, আরিফের আর দোষ কি? আমি তাকে চিঠি দিতে ভুলে গেছি। আজই লিখব।