গোফরান সাহেব নিজে ঢাকায় এসে একতলা, তিন কামরা সেপারেট বাসা ভাড়া নিয়ে আরিফের থাকার ব্যবস্থা করে দিল। তাকে দেখাশুনা ও রান্না করে খাওয়ানোর জন্য এমরকে তার কাছে রেখে গেল।
সে সব আজ থেকে ছয় বছর আগের ঘটনা। এ বছর আরিফের মাস্টার্স কোর্সের পরীক্ষা হবার কথা। কিন্তু সেসন জটের জন্য পিছিয়ে গেছে।
আজ যখন আরিফ খাওয়া-দাওয়ার পর ওমরকে জিজেস করল, কারো দিকে তাকালে কখনো কখনো তার ভূত-ভবিষ্যৎ দেখতে পাই এবং কারো কারো মনের খবর বুঝতে পারি। তখন সে কি উত্তর দেবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে বসে এই সব চিন্তা
আরিফ বলল, কি হল ওমর চাচা, কিন্তু বলছ না কেন?
ওমর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি মূর্ণ মানুষ, কি করে বলব বাবা? আপনি আরো একটু ঘুমান, এত রোদে কোথাও যাবেন না।
আরিফ বলল, ঠিক আছে তুমি এবার খেতে দাও।
আরিফ ভাত খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। যখন তার সুম ভাঙল তখন বেলা সাড়ে চারটে। আসরের নামাজ পড়ে হাসপাতালে এসে প্রথমে খায়ের সাহেবকে বেড়ে দেখতে না পেয়ে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, তিনি সুস্থ হয়ে বাসায় চলে গেছেন। তারপর ফাল্গুনীর বেডের কাছে গেল।
চারটের সময় রুগীদের লোকজনদের আসতে দেখে ফাল্গুনীর চোখ আরিফকে খুজতে লাগল। শেষে যখন পাঁচটা বেজে গেল তখন হতাশ হল, ভাবল, সে হয়তো আসবে না। আকাশীকে জিজ্ঞেস করল, খালা, ঐ ছেলেটা এল না কেন বলতো?
আকাশী বলল, কি করে বলব মা, হয়তো কোন কাজে আটকা পড়েছে। এমন সময় আরিফকে দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখে বলল, এ তো আসছে।
ফাল্গুণী এখন বেশ সন্তু। সে বলল, আমাকে ধরে বসাও।
আকাশী তাকে বসিয়ে দিল।
আরিফ এসে বলল, বেশ দেরি করে ফেললাম, এখন আপনাকে সকালের চেয়ে একটু সুস্থ দেখছে। আলাহ পাকের রহমতে নিয় আগের থেকে ভাল আছেন?
ফাল্গুনী সকালে রাত জাগা উসকো-খুসকো আরিফকে দেখেছিল। এখন ফ্রেশ দেখে মুগ্ধ হল। বলল, জী, আগের থেকে সুস্থ বোধ করছি।
আকাশী বেডের তলা থেকে একটা চুল টেনে দিয়ে বলল, বসুন বাবা বসুন।
আরিফ বসে বলল, আসবার সময় আপনাদের বাসা হয়ে এলাম। আসগর বলল আপনার বাবা রাতে ফোন করেছিলেন। বলেছেন তোরে রওয়ানা দেবেন। এতক্ষণে তো এসে যাবার কথা। হয়তো ফেরীর কারণে দেরি হচ্ছে।
ফাল্গুনী বলল, আপনি চলে যাবার পর আসগর চাচা এসে সে কথা বলে গেছে। আপনার পরিচয়টা বললে খুশি হব।
আরিফ নাম বলে বলল, আমি জুলজীতে মাস্টার্স করছি, বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার সমেশপুর গ্রামে।
হলে থাকেন?
না, একটা বাসা বাড়া নিয়ে থাকি। এবার আপনারটা বলুন।
আমার নাম ফাল্গুণী। বাংলায় অনার্স করছি।
আপনার চেহারার মত নামটাও খুব সুন্দর। আল্লাহপাক আপনার নামের অর্থের মত আপনাকে সৌন্দর্য দান করেছেন, ভাল নাম নিশ্চয় আছে?
ফাল্গুণী এর আগে অনেকের কাছে তার রূপের প্রশংসা শুনেছে, কিন্তু এরকম ভাবে কেউ করেনি। লজ্জায় তার মুখটা রাঙা হয়ে গেল। মৃদু হেসে বলল, আসমা বিনতে ইলিয়াস।
আরিফ সুবহান আল্লাহ বলে বলল, এক্সেলেন্ট। দুটো নামই সার্থক। ফাল্গুনী আরো বেশি লজ্জা পেয়ে বলল, আসমার অর্থটা বলল।
অতুলনীয়।
আপনার নামের অর্থটা জানতে খুব ইচ্ছা করছে।
আমার ডাক নাম আরিফ, আরিফের দুটো অৰ্থ-পবিত্র ও জ্ঞানী। আর আমার আসল নাম আরিফুল্লাহ। তার অর্থ হল, আল্লাহ পবিত্র অথবা আল্লাহ জ্ঞানী। এবার আসি তাহলে?
ফাল্গুনী বলল, এই তো এলেন, এক্ষুনি চলে যাবেন?
না মানে, আপনি তো এখনো অসুস্থ। আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন।
ফাল্গুনী ভিজে গলায় বলল, আপনি থাকলেই বরং সুস্থ বোধ করব।
এমন সময় ইলিয়াস সাহেব সেখানে এসে পৌঁছালেন। তিনি বাসায় না গিয়ে ডাইরেক্ট এখানে এসেছেন।
ফাল্গুনী আব্বা বলে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। আর কোন কথা বলতে পারল না।
ইলিয়াস সাহেবেরও চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। নিজেকে কিছুক্ষণের মধ্যে সামলে নিয়ে মেয়ের মাথায় ও পিঠে হাত বুলাতে বুলোত বললেন, চুপ কর মা প কর। আম্লাহ পাকের কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া জানাই, তিনি তোকে সুস্থ করে দিয়েছেন। রাজশাহী অফিসের ম্যানেজারের কাছে তোর অসুখের খবর শুনে সারারাত আল্লাহর দরবারে দোয়া চেয়েছি, তিনি যেন তোকে হায়াতে তৈয়েবা দান করেন, তোক সুস্থ করে দেন।
ফাল্গুনী বাবাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ মুখ মুছে আরিফকে দেখিয়ে বলল, পরিচয় করিয়ে দিই, ও আরিফ সাহেব, জুওলজীতে মাস্টার্স করছেন। তারপর আরিফের দিকে চেয়ে বলল, আমার আব্বা।
আরিফ আগেই বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়িয়েছিল। সালাম বিনিময় করে বসতে বলল।
ইলিয়াস সাহেব বসে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, এখন যেন আমি?
দুপুরের পর থেকে ভাল আছি। জান আব্বা আরিফ সাহেব সাহায্য না করলে আমি বাঁচতাম কিনা জানি না। ওঁর সাহায্যেই একরকম বেঁচে গেছি।
আরিফ তাকে বাধা দিয়ে বলল, ওরকম কথা বলবেন না। বাঁচা মরা আল্লাহ পাকের হাত। মানুষ হিসাবে যতটুকু করার আমি করেছি
ইলিয়াস সাহেব আরিফের সঙ্গে হাত মোসাফা করে বললেন, তবু আপনি যা করেছেন সে জন্য আন্তরিক মোবারকবাদ জানাচ্ছি।
আরিফ বলল, এবার আমি আসি। তারপর সালাম বিনিময় করে চলে যেতে উদ্যত হলে ইলিয়াস সাহেব বললেন, সময় করে বাসায় আসবেন।
জ্বী আসব বলে আরিফ ফাল্গুনীর দিকে তাকিয়ে দেখল, মিনতিভরা চোখে তার দিকে চেয়ে আছে। বলল, এখন চলি ইনশাল্লাহ আবার দেখা হবে। তারপর দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে চলে এল।