আরিফ চমকে উঠে খুব অবাক হয়ে বলল, দুর! এসব একদম বাজে কথা। তোকে কে বলেছে বল তো?
রফিক বলল; বাজে কথা নয়, বিশ্বাস না হলে গোফরান চাচাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারিস। আর শোন, তোর নানার অনেক জ্বীন-পরী বশ ছিল। সে একটা পরীকে বিয়ে করেছিল। তার দেশ কোথায় কেউ জানে না। কবরস্থানের পাশে যেখানে আমরা ডাব খেতে যাই, সেখানে তোর নানা বেশ কয়েক বছর বসবাস করেছিল। তাদের একটা মেয়ে ছিল, সেই মেয়ে তোর মা। আর ঐখানে যে কবরটা আমরা দেখেছি, সেটা তোর মায়ের।
আরিফ আর একবার চমকে উঠে খুব গম্ভীর হয়ে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইল।
বেশ কিছুক্ষণ পর রফিক বলল, কি রে কিছু বলছিস না কেন?
আরিফ মাথা তুলে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুই এত কথা কার কাছে শুনেছিস?
আব্বার কাছে।
আরিফের তখন ছোট বেলার কথা মনে পড়ল, রফিকের আব্বা সামসু চাচা একদিন তাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। সে কথা আব্বা-আমাকে বলতে তারা বলেছিল, সামসু আমাদের ও তোর দুশমন, তাই তোকে মেরে ফেলতে চায়। সেই থেকে তারা তাকে রফিকের সঙ্গে মিশতে নিষেধ করে আসছে। আরিফ বলল, ঠিক আছে এসব কথা যদি সত্য হয়, তাহলে একদিন না একদিন তা আমি জানতে পারব। এখন চলি পরে দেখা হবে। এই কথা বলে আরিফ ঘরের দিকে রওয়ানা দিল।
ঘরে এসে আব্বাকে পেল না। মাকে সংসারের কাজ করতে দেখে তাকে ঘরে নিয়ে এসে রফিক যা বলেছিল, তা সব বলল।
সুফিয়া বেগম, শুনে আঁৎকে উঠে বলল, সব মিথ্যে কথা। কে তোকে এসব কথা বলেছে?r
আরিফ বলল, এই কিছুক্ষণ আগে রফিক বলেছে। তাকে নাকি তার আব্বা বলেছে।
সুফিয়া বেগম আরিফকে বুকে জড়িয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, ওরা আমাদের দুশমন। তুই ওদের কথা একদম বিশ্বাস করবি না। আমরা তোক সেই ছোট বেলা থেকে রফিকের সঙ্গে মিশতে মানা করে আসছি। তুই তো আমাদের কথা শুনিসনি। তার মনে নেই, রফিকের বাপ তোকে একবার গলা টিপে মেরে ফেলতে চেয়েছিল? তখন না পেরে এখন ছেলেকে দিয়ে মিথ্যে কথা বলে আমাদের প্রতি তোর মন ভাঙাতে চাচ্ছে। আত্মীয়স্বজনরা সবাই আমাদের দুশমন। তুই কারো কথায় কান দিবি না। তারপর আরিফের একটা হাত নিজের মাথায় রেখে বলল, ওয়াদা কর। তুই যদি আমাকে মা বলে জানিস, তাহলে এখন থেকে জীবনে আর কোনদিন রফিকের সাথে মিশবি না, কারো কথায় কান দিবি না।
মায়ের চোখে পানি দেখে আরিফের চোখেও পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বলল, হ্যাঁ আম্মা, আমি ওয়াদা করলাম।
সুফিয়া বেগম নিজের ও ছেলের চোখ মুছে তার মাথায় ও গালে চুমো খেয়ে বলল, মন দিয়ে পড়ানা কর। তোকে আমরা মানুষের মত মানুষ করব। গ্রামের কোন ছেলেরই সঙ্গে মেলামেশা করবি না।
তারপর থেকে আরিফ ও রফিকের মধ্যে বন্ধুত্বের ফাটল ধরলেও রফিকের কথাগুলো তাকে খুব ভাবিয়ে তুলল। তার প্রায়ই মনে হয়, ওরা শত্রু হলেও কথাগুলো সত্য বলেছে। এরপর তার স্বভাব-চরিএের আমূল পরিবর্তন। এতদিন গোফরান সাহেব ও সুফিয়া বেগম তাকে নামাজ পড়ার জন্য কত বুঝিয়েছে; কিন্তু তাদের কথা কানে নেয়নি। এখন সে নিয়মিত নামাজ-কালাম পড়তে শুরু করল। ডানপিটে স্বভাবটাও আর নেই। বেশ ধীর ও গভীর হয়ে গেল। আব্বার যত বাংলায় ধমীয় কেতাব ছিল, সব পড়তে শুরু করল।
গোফরান সাহেব ও সুফিয়া বেগম মনে করল, ছেলে বড় হবার সাথে সাথে স্বভাব চরিত্র পাল্টে গেছে। আরিফ ম্যাটিকে খুব ভাল রেজাল্ট করে সিরাজগঞ্জ কলেজে আই. এস, সি তে ভর্তি হয়ে মন দিয়ে পড়াশুনা করতে লাগল। যে সময়গুলোতে রফিকের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত, সেই সময়গুলো আরিফের যেন কাটতে চায় না। তার প্রায় সেই কবরটার কথা মনে পড়ে। সেখানে যেতে মন চায়।
একদিন বিকালে ওমরের সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়ে কবরস্থানের দিকে যেতে লাগল।
ওমর বলল, ওদিকে যাচ্ছ কেন? ওদিককার জায়গা ভাল নয়।
আরিফ বলল, কেন? ভাল নয় কেন?
সে সব তোমার না শোনাই ভাল।
নাই ভাল হোক, তবু তুমি বল।
ওমর হাত বাড়িয়ে কবরস্থানের পাশের জায়গাটা দেখিয়ে বলল, ঐ জায়গায় জীন পরীরা থাকে।
আরিফ বলল, আমি ও রফিক ওখানে প্রায় ডাব খেতে যেতাম। সে সময় একটা পাকা কবর দেখেছি। দেখে মনে হল, একদম নতুন। কবরের চারপাশে কেউ যেন প্রতিদিন ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে। জীন-পরী থাকলে ওখানে কেউ এসে ঝাড়ু দিতে পারত না। আচ্ছা ওমর চাচা, তুমি কি জান, ওটা কার কবর?
ওমর সব কিছু জানে। আরিফকে কোন কিছু জানাতে গোফরান সাহেবের নিষেধ। তাই বলল, শুনেছি এটা কোন পরীর কবর। তাদেরই কেউ হয়তো প্রতিদিন ঝাড় দিয়ে যায়। ততক্ষণে তারা সেই জায়গার কাছাকাছি এসে পড়েছে। ওমর দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ওখানে গিয়ে কাজ নেই, অন্য দিকে যাই চল।
আরিফ ওমরের কথার মধ্যে রফিকের কথার যেন একটু মিল খুঁজে পেল। বলল, চল না চাচা, এতদূর যখন এসেছি কবরটা একবার দেখে যাই, কবরটা দেখতে খুব ইহে করছে। তারপর সে চলতে শুরু করল।
ওমর এক রকম বাধ্য হয়ে তার সঙ্গে এগোল।
ফেরার পথে ওমর বলল, তুমি যেন একা একা এখানে আর কোনদিন এসো না। আর আজ যে এসেছিলে, সে কথা তোমার আব্বা-আমাকে বলো না।
ওমর চাচার কথা শুনে আরিফের মায়ের সাবধান বাণীর কথা মনে পড়ল, সেও তাকে এদিকে আসতে নিষেধ করেছে। কিন্ত তার মন যে মানে না। প্রতিদিন কবরের কাছে আসতে তার মন চায়। সেই জন্যে ওমরকে অন্য কাজে পাঠিয়ে প্রায়ই একাকি ঐ কবরের কাছে আসে। জীন-পরীর ভয়ের কথা তার মনেই পড়ে না। এভাবে দুবছর পর আই. এস. সি. পাস করে আরিফ ঢাকায় ভার্সিটিতে জুওলজীতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হল।