রফিক বলল, তুই ঠিক বলেছিস। শালা এইসব গাছে এত ভাব আছে আগে জানলে এমের লোকের ডাব চুরি করে খেতাম না। রফিক ও আরিফদের প্রচুর ডাব গাছ থাকলেও তারা দুম করে অন্যের গাছের ডাব খেত।
আরিফ বলল, আজ আমি উঠি, কাল তুই উঠিস। তারপর সে তর করে গাছে উঠে ডাব পেড়ে নামার সময় সেখীর কাছ থেকে হাত ফসকে পড়ে গেল।
রফিকের বুক ধড়াস করে উঠল। ভাবল, অত উঁচু থেকে পড়ে আরিফ হয়তো মরেই গেল। ভয়ে ও আতকে কয়েক সেকেন্ড নড়তে-চড়তে পারল না। তারপর আরিফকে ওঠহাত-পায়ের ধুলো ঝড়তে দেখে খুব অবাক হল। তার কাছে এসে বলল, কিরে তুই বেঁচে আছিস? আমি মনে করেছি তুই মরেই গেছিস। যা ভয় পেয়েছিলাম না।
আরিফ বলল, আরে মরণ কি এতই সহজ। যার যখন হায়াৎ শেষ হবে, সে তখন মরবে।হায়াৎথাকতে কেউ মরে না, বুঝলি।
রফিক বলল, তা না হয় বুঝলাম; কিন্তু অত উঁচু থেকে পড়ে গেলি অথচ তোর হাত পা ভাঙল না,এটা অবাক লাগবে।
আরিফ বলল, তোর মত আমিও খুব অবাক হচ্ছি। হাত রুমকে যেতে ভাবলাম, পড়ে গিয়ে হয়তো মরেই যাব অথবা হাত-পা ভেঙে গুড়ো হয়ে যাবে। সে কথা ভেবে খুব ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে নিয়েছিলাম। হঠাৎ মনে হল কেউ যেন আমাকে ধরে মাটিতে শুইয়ে দিল। দেখ না পড়ে গিয়ে আমার গায়ে একটুও আঁচড় লাগেনি। এই কথা বলে হাত-পা দেখাল।
রফিক বলল, আব্বা একদিন আমাকে এদিকে আসতে নিষেধ করেছিল। এখানে নাকি জীন-পরীরা বাস করে। তাদেরই কেউ হয়তো তোকে ধরে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছে। তাই তোর কোন ক্ষতি হয়নি।
আরিফ বলল, আমাকেও আব্বা একদিন ঐ কথা বলে এদিকে আসতে নিষেধ করেছিল। আমি কিন্তু ওসব বিশ্বাস করিনি।
রফিক বলল, বাদ দে ওসব কথা, এখন ডাব খাওয়া যাক।
ডাব খাওয়ার পর আরিফ বলল, ডাব গাছে উঠ উওর দিকে একটা পাকা কবর দেখেছি। চল দেখে আসি।
রফিক অবাক হয়ে বলল, তাইনাকি! চল ত দেখি।
কবরের কাছে এসে তারা খুব অবাক হল। কবরটা যেন মাত্র কয়েক দিন আগে তৈরি হয়েছে। আরিফ বলল, কি ব্যাপার বল তো? প্রায় ছয়-সাত মাসের মধ্যে আমাদের গ্রামে কেউ মারা গেছে বলে শুনিনি। তাছাড়া কবর পাকা করার মত টাকা, আমাদের আর তোদের ছাড়া কার আছে?
রফিক বলল, আমিও সে কথা ভাবছি। আরো একটা কথা ভাবছি, মনে হচ্ছে কেউ যেন কবরের চারপাশ প্রতিদিন ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করে।
আরিফ বলল, হ্যাঁ আমারও তাই মনে হচ্ছে।
রফিক বলল, চল এবার ঘরে যাই।
ফেরার পথে রফিক বলল, তুই যেন আবার ঘরে গিয়ে তোর আবা-আম্মাকে এসব কথা বলিসনা। তা না হলে তারা তোকে আর এদিকে আসতে দেবে না। এমনিতেই ওমর সব সময় তোর সঙ্গে থাকে।
আরিফ বলল, তুই পাগল হয়েছিল। একথা কাউকে বলব না। আর তুইও কাউকে বলবি না।
এর পর থেকে তারা প্রায়ই ডাব খেতে এখানে আসে।
আজ আবার মুখে আরিফের আসল পরিচয় পেয়ে রফিক ভাবল, আব্বার কথাই ঠিক, নচেৎ সেদিন অত বড় ভাব গাছ থেকে পড়ে গিয়েও তার কিছু হল না কেন? আর আরিফও সেদিন বলেছিল, তাকে কেউ যেন ধরে মাটিতে শুইয়ে দিল।
ছেলেকে চুপ করে থাকতে দেখে সামসু ভাবল, এবার হয়তো কাজ হবে। বলল, খবরদার আরিফের সঙ্গে মিশবি না, ওর সাথেও জীন-পরী থাকে।
রফিক কবরের কথাটা এতদিন কাউকে না বললেও আজ আব্বাকে জানাল।
সামসু শুনে চমকে উঠে বলল, সর্বনাশ! করেছিস কি? ঐ জায়গাটা হল জীন পরীদের আডডা। আর ঐ কবরটা হল আরিফের মায়ের। জীন-পরীরা প্রতিদিন কবরের চারপাশ পরিষ্কার করে। আরিফ পরীর ছেলে, তাকে তারা কিছু বলবে না বরং সাহায্য করবে। তাই তো সেদিন গাছ থেকে পড়ে যাবার সময় জীনেরা তাকে ধরে নামিয়েছে। খবরদার, আর কখনও ঐদিকে যাবি না।
আব্বার কথাগুলো রফিকের দৃঢ় বিশ্বাস হল। বলল, ঠিক আছে আবা, আমি আর আরিফের সঙ্গে মিশব না, ঐ জায়গাতেও কোনদিন যাবনা। আর আরিফকে তার আসল পরিচয় জানাব।
সামসু চিন্তা করল এবার হয়তো তার মনের ইচ্ছা পূরণ হবে।
৪. ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর
ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর হাতে অফুরন্ত সময়। তার উপর কয়েকদিন থেকে রফিকের পাত্তা নেই। পাশাপাশি বাড়ি হলেও আরিফ আহ্বা-আম্মার কথা মত কোনদিন রফিকদের বাড়িতে যায় না। যেখানে যেখানে তারা ঘুরে বেড়ায়, আড্ডা দেয়, সেসব জায়গায় আরিফ খোঁজ করেও তাকে পেল না। ভাবল, সে হয়ত কোন আত্মীয়ের বাড়ি গেছে। কিন্তু তাকে না বলে সে তো কোনদিন কোথাও যায় না। কোন অসুখ-টসুখ করেনি তো? এই কথা মনে হতে তাদের চাকরকে জিজ্ঞেস করল।
চাকরটা বলল, সে তো কয়েকদিন আগে তার নানার বাড়ি গেছে।
শুনে তার প্রতি আরিফের অভিমান হল। আরো তিন-চার দিন পর এক সকালে রফিকের সাথে দেখা হতে বলল, কিরে আমাকে না বলে যে, নানার বাড়ি চলে গেলি? কবে ফিরলি?
রফিক বল, কাল সন্ধ্যায় ফিরেছি। চল মক্তবের বারান্দায় বসি, তোর সাথে কথা আছে।
মক্তবের বারান্দায় বসে রফিক বলল, তোকে কয়েকটা কথা বলব, কিছু মনে করবি। আমি কথাগুলো আগে জানতাম না, কয়েকদিন আগে জেনেছি।
আরিফ বলল, তোর কথায় কিছু মনে করব কেন? বল কি বলবি?
তোর আসল পরিচয় কি তুই জানিস?
আসল পরিচয় আবার কি?
তুই যাদেরকে মা-বাবা বলে জানিস, তারা কিন্তু তোর আসল মা-বাবা নয়। তারা হল তোর ফুফা-ফুফি। তুই হলি গোফরান চাচার ছোট শ্যালক জাকিরের ছেলে। তোদের বাড়ি এনায়েতপুরে। তোর মা-বাবা তোকে খুব ছোট রেখে মারা যায়। এই ফুফা-ফুফি তোকে ছেলের মত মানুষ করেছে।