গোফরান সাহেবের তখন নেসার ফকিরের কথা মনে পড়ল। আরিফ যে এরকম কথা বলবে তা তিনি বলেছিলেন। ওমরকে বলল, তুমি এসব কথা অন্য কাউকে বলবে
ওমর মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চলে গেল।
গোফরান সাহেব স্ত্রীকে ওমরের কথা বলে জিজ্ঞেস করল, আরিফের বয়স কত হল বল তো?
সুফিয়া বেগম হিসাব করে বলল, পাঁচ বছর পার হয়েছে। নেসার ফকির যে তাবিজ পরাবার জন্য দিয়েছিলেন তার এখনো এক বছর দেরি আছে। তারপর আরিফের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বলল, তুমি তোমার ওমর চাচার কাছে যে সব কথা বলেছ, সে সব অন্য কারো কাছে বলো না। আবার যখন এরকম কথা তোমার মনে হবে তখন ওমরকে বা অন্য কারো কাছে না বলে আমাদের কাছে বলবে।
সে বছর সত্যি সত্যি বসন্ত হয়ে অনেক লোক মারা গিয়েছিল। এর কিছুদিন পর আরিফ স্কুলে ভর্তি হল। একদিন স্কুল থেকে ফিরে মা বাবাকে বলল, সামস চাচা আজ আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চেয়েছিল; কিন্তু আমার গলায় চাপ দিতে পারেনি। কয়েকবার চেষ্টা করে যখন পারল না তখন বলল, তোর মা পরী ছিল তাই বেঁচে গেলি। তারপর ওর চাচাকে আসতে দেখে আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল।
সুফিয়া বেগম ভয়ার্ত করে জিজ্ঞেস করল, তোর ওমর চাচা তোকে রেখে কোথায় গিয়েছিল?
আরিফ বলল, সে আমাকে রাস্তার একপাশে দাঁড়াতে বলে একটু দূরে পায়খানা করতে গিয়েছিল।
গোফরান সাহেব জিজ্ঞেস করল, তাকে এই কথা বলেই নাকি?
আরিফ মাথা নেড়ে বলল, না। তারপর মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আচ্ছা আশা, সামস চাচা আমাকে মেরে ফেলতে চায় কেন? আর কেন সে বলল, আমার মা পরী ছিল? তাহলে তুমি কে?
সুফিয়া বেগম চমকে উঠে আরিফকে বুকে জড়িয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, তোর সামসু চাচা মিথ্যে বলেছে। তার কথা বিশ্বাস করিস না। সে আমাদের সকলের দুশমন।
গোফরান সাহেব বলল, হ্যাঁ বাবা, তোমার আশা ঠিক কথা বলেছে। সাম আমার চাচাতো ভাই হলে কি হবে আমাদের দুশমন। তোমাকে মেরে ফেললে, সে আমাদের সব সম্পত্তি পাবে, তাই তোমাকে মেরে ফেলতে চায়। তারপর ওমরকে ডেকে বলল, তুমি আরিফকে রাস্তাঘাটে একা রেখে কোথাও যাবে না। আজ রাস্তায় রেখে তুমি যখন পায়খানা করতে গিয়েছিল, সেই সময় সামসু ওকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। তোমাকে আসতে দেখে পালিয়ে যায়।
ওমর চমকে উঠে বলল, তাই নাকি দাদা? আমিও এবার সজাগ থাকব, দেখব কে আরিফের গায়ে হাত দেয়।
তার পর আরিফের বয়স সাত বছর হতে গোফরান সাহেব ও সুফিয়া বেগম নেসার ফকিরের কথা মত তার গলায় একটা তাবিজ বেঁধে দিল।
গোফরান সাহেবের চাচাতো ভাই সামস। সেও বাবা-মার একমাত্র সন্তান। তার চার মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলেটা সবার ছোট। নাম রফিক। রফিক খুব দুরন্ত ছেলে। কোন কিছুতে ভয় পায় না। তার সঙ্গে আরিফের খুব ভাব। আরিফও তার বাবার প্রথম জীবনের মত ডানপিটে হয়েছে। গ্রামের বয়স্ক লোকেরা আরিফকে গোফরান সাহেবের শালার ছেলে এবং নেশার ফকিরের নাতি বলে জানলেও অনেকে গোফরান সাহেবের ছেলে বলেই জানে। তাই আরিফের ডানপিটে স্বভাবের কথা জেনেও কেউ কিছু বলে না। কিন্তু সামসু আরিফের সব কিছু জানে। গোফরান সাহেবের ছেলেমেয়ে হয়নি বলে সে খুব খুশি ছিল। কারণ নিঃসন্তান চাচাতো ভাইয়ের মালিক সে একসময় হত। গোফরান আরিফকে পোষ্যপুত্র করায় তার সে আশায় বাজ পড়ে। তাই সে আরিফকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চায়। আল্লাহপাকের কি কুদরত, সামসুর ছেলে রফিকের সঙ্গে আরিফের বন্ধুত্ব দিনের পর দিন গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে। ছোটবেলা থেকে দুজনের ভাব-চরিত্রও প্রায় একই রকম। এত বড় হতে লাগল, তত গ্রামের লোকজন তাদের দুরন্তপনায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। গোফরান সাহেব ও সুফিয়া বেগম শাসন করতে পারে না, তবে অনেক বোঝায়। কিন্তু কোন কাজ হয়নি।
সামসুও ছেলেকে আরিফের সঙ্গে মিশতে নিষেধ করে, অনেক বোঝায় এবং তাতে কাজ না হতে শাসনও করেছে; কিন্তু ফলাফল কিই হয়নি। শেষে সামসু ছেলে বড় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। তারপর যখন ম্যাট্রিক পাস করল তখন একদিন রফিককে আরিফের আসল পরিচয় জানিয়ে বলল, ও পরীর পেটে হয়েছে। ওর সঙ্গে মেলামেশা ছেড়ে দে। ওর নানার জীন-পরীর সাথে কারবার ছিল। সেও একদিন তাই করবে। ওর সাথে সব সময় একজন জীন থাকে। সেই জীন তোর ক্ষতি করতে পারে। তাছাড়া ও পরের ছেলে। উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। ও না থাকলে তোর গোফরান চাচার সব সম্পত্তির মালিক আমরা হতাম। আরিফের বাপেরও অনেক বিষয়-সম্পত্তি ও ব্যবসাপত্র আহে। সে সব ওর চাচা ভোগদখল করছে। বড় হয়ে আরিফ সেসব পাবে। তার উপর তোর গোফরান চাচার সব বিষয়-সম্পত্তি পেয়ে কত বড়লোক হয়ে যাবে। আর তুই কি পাবি? আমার আর কতটুকু আছে। ওকে এখান থেকে তাড়াতে পারলে তোর গোফরান চাচার সবকিছু তুই পাবি। তারা আরিফকে তার আসল মা-বাপের কথা বলেনি। তুই তাকে ববি। বললে, আমি মনে কষ্ট পেয়ে তার চাচার কাছে চলে যাবে। তারপর গোফরান ও তার বৌ মারা যাবার পর তাদের সম্পত্তি তুই একা পেয়ে যাবি।
রফিক বাবার কথা শুনে বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপারটা যতটা না বিশ্বাস করল, তার চেয়ে জীন-পরীর কথাটা বেশি বিশ্বাস করল। রণ তখন তার গত বছরের একদিনের ঘটনা মনে পড়ল তখন গরমের সময়। স্কুল বন্ধ। অনেক দিন বৃষ্টি না হওয়ায় গরম খুব জানাচ্ছে। সেদিন দুপুরের পর লোকজন সখন ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে তখন ওরা দুজন কবরস্থানের পাশে যেখানে নেসার ফাঁক ঘর করে বসবাস করেছিলেন, সেখান গেল। এখন সেখানে বাড়ির চিহ্ন নেই। জলে ভরে গেছে। তবে নেসার ফকির চলে যাবার পর অনেক গরিব মেয়ে জ্বালানির জন্য গাছের শুকনো পাতা ও ডালপালা নিতে সেখানে যায়। কি আগের মত কেউ আর অসুস্থ হয়ে মারা যায় না। নেশার ফকির তিন-চারটে নারকেল গাছ লাগিয়েছিলেন। সেগুলোতে এর নারকেল হয়। কেউ সেসব পেড়ে আনতে সাহস পায় না। গাছেই শুনো হয়ে যখন পড়ে তখন ঐসব গরিব মেয়েরা কুড়িয়ে নিয়ে আসে। আগের দিন বিকেলে দুবাতে অন্য গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিল। ফেরার পথে কবরনের পাশ দিয়ে আসবার সময় সেই সব গাছে প্রচুর ভাব দেখেছে। তাই আজ দুজনে বুক্তি করে একটা বড় চাকু নিয়ে এখানে ডাব খেতে এসেছে। দুজনেই গাছে চড়তে ওস্তাদ। সেখানে এসে আরিফ বলল, প্রতিদিন এখানে ডাব খেতে আসব, কি বলিস।