যাবার আগে ঐ মেয়েটির কথা মনে পড়তে তাকে দেখতে গেল। গিয়ে দেখল তার জ্ঞান ফিরেছে। জিঞ্জেস করল, এখন কেমন আছেন?
: ভাল, কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনতে পারছি না।
আমাকে চিনবেন না। গতকাল আমার বাবাকে নিয়ে এখানে এসেছি। যে ছেলেটা আপনাকে সাহায্য করেছে আমি তারই বন্ধু। এখন বাবাকে নিয়ে চলে যাচ্ছি। তাই ভাবলাম, আপনাকে একটু দেখে যাই। আয় এবার আলি, আল্লাহ হাফেজ।
ঐ মেয়েটির নাম ফাল্গুনী। সকালের দিকে জ্ঞান ফিরে পেয়ে চারদিকে চেয়ে বুঝতে পারল, হাসপাতালে আছে। আকাশীকে জিজ্ঞেস করল, খালা, আমাকে এখানে কখন নিয়ে এলে?
আকাশী বলল, গতকাল বেলা দুটোর সময় তুমি যখন অজ্ঞান হয়ে গেলে তখন একটা বেবিতে করে নিয়ে আসি। তারপর কিভাবে আরিফ তাকে সাহায্য করল সে কথা বলে আরো বলল, মনে হয় ছেলেটা এখনো বাইরে বসে আছে। রাতে কয়েকবার তোমাকে দেখে গেছে। ডাক্তার ও নার্সকে তোমার দিকে লক্ষ্য রাখতে বলেছে। এই তে কিছুক্ষণ আগেও এসেছিল। আবার হয়তো আসবে।
ফাল্গুনী জিজ্ঞেস করল, আব্বাকে খবর দেওয়া হয়েছে?
আকাশী বলল, ঐ ছেলেটা আমার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে বাসায় গিয়েছিল। ফিরে এসে বলল, রাজশাহীতে টেলিফোন করে খবর দেওয়া হয়েছে।
ফাল্গুনীর মন আরিফের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল। ভাবল, যার মধ্যে এত মানবতা রয়েছে নিশ্চয় সে দেখতেও সুন্দর। আকাশীকে বলল, তাকে ডেকে নিয়ে এস।
আকাশী বাইরে এসে আরিফকে পেল না। ফিরে এসে বলল, তাকে পেলাম না।
আরিফ ভোরে মেয়েটিকে দেখে মসজিদে ফযরের নামাজ পড়তে গিয়েছিল। নামাজ পড়ে পাঞ্জে সূরা তেলাওয়াত করে মেয়েটির রোগমুক্তির জন্য দেওয়া করল। তারপর এসরাকের নামাজ পড়ে ফিরে আসার সময় চিন্তা করল, মেয়েটি যদি ভাল থাকে, তাহলে বাসায় গিয়ে গোসল ও খাওয়া-দাওয়া করে আসবে। হাসপাতালে ঢুকে ওয়ার্ডের কাছে গিয়ে দেখল, মেয়েটির জ্ঞান ফিরেছে। মনে মনে আল্লাহপাকের শোকর গোজারি করে বেডের কাছে এসে তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, এখন কেমন বোধ করছেন? সারারাত খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম।
আরিফের রাতজাগা মলিন চেহারা দেখে ফাল্গুনীর মন ব্যথায় টনটন করে উঠল। তারপর কয়েক সেকেন্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ভিজে গলায় বলল, আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা আমার নেই। আকাশী খালার মুখে যা শুনেছি তা অতি আপনজনও করে না।
আরিফ বলল, কি আর এমন করেছি। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন। আপনাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে দেন। এখন আমি একটু বাসায় যাব, পরে আবার আসব।
ফাল্গুনী কিছু বলার আগে আকাশী বলল, হ্যাঁ বাবা তাই যান। সারারাত কষ্ট তো আর কম করেননি? বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিন।
আরিফ ফাল্গুনীর মুখের দিকে চেয়ে বলল, আসি কেমন? তারপর সেখান থেকে বাসায় এসে গোসল করে নাস্তা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
দুপুরে ওমরের ডাকাডাকিতে ঘুম থেকে উঠে বলল, এত ডাকাডাকি করছ কেন ওমর চাচা?
গোফরান সাহেব আর সুফিয়া বেগম সাড়ে তিন বছরের আরিফকে যখন নিয়ে আসে তখন তাকে দেখাশুনা করার জন্য গোফরান সাহেব এমরকে মাসিক বেতনে নিজের বাড়ীতে এনে রাখে। আরিফের সঙ্গে সবসময় থাকাটাই ওমরের কাজ। তাকে অন্য কোন কাজ করতে দেওয়া হয় না। বলাবাহুল্য, নেসার ফকিরের দেওয়ার বরকতে এই ওমরেরই গুলো পা ভাল হয়ে গিয়েছিল। যাই হোক আরিফ যতদিন গ্রামের বাড়ীতে লেখাপড়া করেছে, ততদিন ওমর তার নিত্যসঙ্গী ছিল। ঢাকায় পড়তে আসার সময়। গোফরান সাহেব ও সুফিয়া বেগম তাকে আরিফের সেবাযত করার জন্য আলাদা বাসা ভাড়া নিয়ে ওমরকে তার কাছে রেখেছে। মাঝে মাঝে গোফরান সাহেব ও সুফিয়া বেগম এসে বেশ কিছুদিন থেকে আবার চলে যান। তারা সময়মত ওমরের বিয়ে দিয়েছেন। বেয়ের নাম আনোয়ারা। আনোয়ারা গরিব ঘরের মেয়ে। কিন্তু খুব কর্মঠ ও স্বামীভক্ত। ওমরকে সব সময় আরিফের কাছে থাকতে হয়। আরিফ যখন বাড়ী যায় তখন ওমরও তার সঙ্গে যায়। গোফরান সাহেব ও সুফিয়া বেগম আনোয়ারাকে নিজেদের কাছে রেখেছেন। তাদের কোন ছেলেমেয়ে হয়নি।
আরিফের কথা শুনে ওমর বলল, কাল সারাদিন ও সারারাত কোথায় ছিলেন? বন্ধুর বাসায় যাবার কথা বলে সেই যে গেলেন আর ফিরলেন না। আমি সারারাত জেগে কাটিয়েছি। সকালে এসে নাস্তা খেয়ে ঘুমিয়েছেন, এখন বেলা দুটো বাজে। ডাকাডাকি করব না তো কি করব? খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত না করলে শরীর টিকবে কেন? সাহেব বেগম এসে আপনার শরীর রোগা হয়ে গেছে দেখলে, আমাকে বকাবকি করবেন। a ওমর নিরেট মূ। দেশে থাকাকালীন সময়ে ওমর তাকে ছোটবেলা থেকে একরকম মানুষ করেছে বলে তুমি করেই বলত। ঢাকায় আসার পর আরিফ তাকে কিছু কিছু বাংলা-ইংরেজী শিখিয়েছে। কার সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় তাও শিখিয়েছে। প্রথম দিকে ওমর অভ্যাসমত সবাইকে তুমি করে বলত। তারপর আরিফের কথামত এখন আর সেরকম করে না। বেশ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারে।
আরিফ বিছানা ছেড়ে উঠে বাথরুমে যাবার সময় বলল, তুমি যাও, আমি নামাজ পড়ে ভাত খাব।
খাওয়া-দাওয়ার পর আরিফ ওমরকে বলল, আচ্ছা ওমর চাচা, কখনো কখনো কারো দিকে তাকালে তার ভূত-ভবিষ্যৎ দেখতে পাই, তার মনের কথা বুঝতে পারি, এরকম কেন হয় বলতে পার?
ওমর আরিফের আসল পরিচয় জানে। তার মা বাবাকে ও নানা নানীকে জানে। আরও জানে আরিফের ছোট বেলার ইতিহাস। আরিফের বয়স যখন পাঁচ বছর তখন একদিন মাদ্রাসা থেকে ঘরে ফেরার সময় ওমরকে বলল, ওমর চাচা, এ বছর গ্রামে বসন্ত হয়ে অনেক লোকজন ও হেলেমেয়ে মারা যাবে। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কয়েকটা ছেলেমেয়ের নাম বলে বলল, এরাও মারা যাবে। এর আগেও আরিফ ওমরকে এমন কিছু কথা বলেছিল যা কিছুদিনের মধ্যে ঘটেছিল। তখন ওমর মনে করেছিল, আরিফ পরীর পেটে জন্মেছে, তাই হয়তো আগাম ঘটনা জানতে পারে। তারপর যখন আরিফ খাঁমে বসন্ত হয়ে অনেকে মারা যাবার কথা বলল তখন ওমর ভাবল, এই কথা গ্রামের লোকজন জানতে পারলে খুব খারাপ হবে। ঘরে এসে গোফরান সাহেবকে সে কথা জানিয়ে বলল, আগেও সে আমাকে এরকম যত কথা বলেছে তা সব সত্য হয়েছে।