রীমা আতঙ্কিত স্বরে মিনতি করল, না আরিফ ভাই না। আপনাকে থাকতে হবে। আপনি একটা কলেরা রুগীকে দুহাতে জড়িয়ে ভিতরে এনেছেন। একজন উচ্চশিক্ষিত ছেলে হয়ে এটা জানেন না, আপনার সর্ব প্রথম কর্তব্য হল, সাবান দিয়ে গোসল করে অন্য পোশাক পরা!
আরিফ মৃদু হেসে বলল, আপনার কথা অস্বীকার করছি না; তবে আপনি বোধ হয় জানেন না, সাবধানের যেমন মার নেই, তেমনি মারের সাবধান নেই।
রীমা বলল, দোহাই আপনার কথা না বাড়িয়ে যা বললাম তাই করুন।
আরিফ বলল, আপনি তো মায়ের জাত, তাই সব কিছুতেই অমঙ্গল চিন্তা করেন।
রীমা অধৈর্য হয়ে বলল, আহ আরিফ ভাই, তর্ক না করে শিগগির বাসায় যান।
আরিফ দৃঢ়স্বরে বলল, আপনি ওগুলো নিয়ে ভিতরে যান। আবসার আসার পর আপনার আদেশ পালন করব।
রীমা জানে আরিফ ভাই নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করে না, তাই তার কথা শুনে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চলে গেল।
আরিফ আগের জায়গায় বসার জন্য আসবার সময় দেখল, ফয়সাল ফুটপাতে একটা গাছের ছায়ায় বসে আছে। তার কাছে এসে পাশে বসে বলল, তখন আপনি মেয়েটিকে সাহায্য করতে আমার সঙ্গে এলেন না কেন? কোন অসুখকেই ভয় করা উচিত নয়।
ফয়সাল বলল, আমাকে ভুল বুঝবেন না। অসুখকে ভয় করে নয়, মেয়েরুগী বলে যাইনি।
কেন? রুগী রুগীই। সে মেয়ে হোক অথবা পুরুষ হোক। বিপদের সময় মেয়ে পুরুষ বিচার করা অজ্ঞতার পরিচয়।
বেগানা মেয়ের গায়ে হাত দেওয়া শক্ত গোনাহ।
আরিফ খুব অবাক হয়ে বলল, আপনি নিশ্চয় পড়াশুনা করছেন?
জ্বী, আলিয়া মাদ্রাসার ফাজেলের ছাত্র।
তবু এমন কথা বলতে পারলেন?
কেন? কোন অন্যায় বলেছি নাকি?
নিশ্চয়ই।
আপনারা কোরআন-হাদিস পড়েন নি, আপনাদের ন্যায়-অন্যায় বোধ অন্য রকম।
আপনার কথা মানতে পারলাম না। আমি মুদ্রাসায় না পড়লেও আল্লাহপাকের রহমতে অনেক ধর্মীয় বই পড়েছি। কোরআন-হাদিসের ব্যাখ্যাও পড়েছি। সেগুলোর মধ্যে বিপন্না নারীকে সাহায্যার্থে তার গায়ে হাত দিলে শক্ত গোনাহ হবে, একথা কোথাও পাইনি। জানেন না বুঝি, খুব বড় বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য মিথ্যা বলা। জায়েজ? হারাম খাদ্য ছাড়া বাঁচার অন্য কোন উপায় না থাকলে, হারাম খাওয়া জায়েজ। অবশ্য বিপদ দূর হবে এবং হালাল খাবার পাওয়া গেলে ঐ সব নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তখন আল্লাহপাকের কাছে তওবা করে মাফ চেয়ে নিতে হয়। আসল কথা কি জানেন, মানুষ যা কিছু করুক না কেন আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে করলে তাকে গোনাহ স্পর্শ করতে পারে না। সব থেকে বড় কথা, মানুষ জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে সেগুলো মেনে চলবে এবং আল্লাহকে ভয় করে নিজেকে চরিত্রবান করে গড়ে তুলবে। তা যদি কেউ করতে পারে, তাহলে শয়তান তাকে দিয়ে কোন গোনাহর কাজ করাতে। পারবে না। একটা কথা না বলে থাকতে পারছিনা, আমি যতটুকু জ্ঞান লাভ করেছি, তাতে করে আমার মনে হয়, ধর্ম ও কিছু আনুষ্ঠানিক জিনিস নয়। ধর্মের মূল উদ্দেশ্য হল একত্ববাদ এবং নির্মল চরিত্র গঠন। হাদিস সম্বন্ধে আপনি আমার চেয়ে বেশি জান রাখেন; তবু একটা হাদিস না বলে পারছি না— রসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, মুসলমানদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উওম যে অধিক ধর্ম ভীরু ও চরিত্রবান। আর একটা কথা মনে রাখবেন, সমস্ত মানবকুলের উপকার করাই ইসলাম ধর্মের প্রধান হুকুমগুলোর মধ্যে অন্যতম।
এমন সময় আবসারকে আসতে দেখে বলল, এবার আসি, আমার কথায় মনে কি নিবেন না। তার সালাম বিনিময় করে আবসারের দিকে এগিয়ে গেল
আবসার সাড়ে তিনটের সময় ফিরে এসে আরিফকে দেখে বলল, তোর জন্য। ভাত এনেছি।
আরিফ বলল, তোর বৌয়ের হুকুম বাসায় গিয়ে সাবান দিয়ে গোসল করে জামা-কাপড় পরে তারপর যেন খাঁই।
এরকম হকুম জারি করার পিছনে নিশ্চয় কোন কারণ আছে?
সেটা তার বৌকেই জিজ্ঞেস করিস জলে আরিফ আমার উদ্দেশ্যে রওয়ান দি।পথে আরিফের, মনে ঐ মেয়েটির ছবি ভেসে উঠল। ভাবল, এখন কেমন আর আল্লাহকে মালুম। বাসায় এসে গোসল ও খাওয়া-দাওয়া করে হাসপাতালে যখন ফিরে এল তখন প্রায় পাঁচটা বাজে। খায়ের সাহেবের বেডের কাছে এসে তখনও স্যালাই। চলছে দেখে আবসারকে জিজ্ঞেস করল, কিরে খালুজান এখন কেমন আছেন?
আবসার বলল, খিচুনি বন্ধ হয়েছে গত?
রীমা জায়গা ছেড়ে দিয়ে বলল, বসুন আরিফ ভাই।
আমি অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি, এবার একটু দাঁড়াই।
আরিফ বসে তাকেই উদ্দেশ্য করে বলল, ভাবী এ মেয়েটি কেমন আছেন জানেন
রীমার ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলে গেল। বলল, পাশের ওয়ার্ডের দরজা দিয়ে ঢুকে ডান দিকের বেডে মেয়েটা আছে। যান, গিয়ে দেখে আসুন। আমি কিছুক্ষণ আগে গিয়ে দেখে এসেছি। অবস্থা তেমন ভাল নয়। তার কাছে যে বয়স্ক মেয়েটি রয়েছে, তাকে আমি মেয়েটার বাবা-মার কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম বলল, মা নেই, বাবা আছেন। তিনি গতকাল রাজশাহী গেছেন। দুতিন দিন পর ফিরবেন।
আরিফ মেয়েটির বেডের কাছে এসে বয়স্কা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, এখন কেমন আছে?
বয়স্ক মেয়েটির নাম আকাশী। সে বলল, বমি বন্ধ হয়েছে; কিন্তু পায়খানা সমানে হচ্ছে।
আরিফ আবার জিজ্ঞেস করল, বাসায় কে কে আছে
আকাশী বলল, একজন কাজের লোক, একজন মালি ও একজন কাজের মেয়ে আছে। সাহেবের আর কোন ছেলে-মেয়ে নেই। এই মেয়েকে দশ বছরের রেখে বেগম সাহেবা মারা গেছেন। আমি সাহেবের দেশের মেয়ে! বেগম সাহেব মারা যাবার পর আমি একে মানুষ করেছি।