রীমা গার্মেন্টসে চাকরি করলেও কাটিং শিখেছি। মীর ঘরে এসে কিছু দিনের মধ্যে সবার মন জয় করে নিল। তারপর স্বামী ও শ্বশুরের সহায়তায় বাসাতেই মেয়েদের সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে ভাল টাকা রোজগার করতে লাগল। বছর খানেকের মধ্যে সংসারে উন্নতি দেখে শুর-শাশুড়ীর খুব প্রিয়পাত্র হয়ে উঠল। রীমা যে শুধু প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নিয়ে ব্যস্ত থাকত তা নয়, সেই সঙ্গে সংসারের সব কাজ ও শ্বশুর-শাশুড়ীর সেবা যত্নের দিকে খুব লক্ষ্য রাখত। অবশ্য সংসারে অন্যান্য কাজের জন্য একজন মেয়ে রেখেছে। যে সব আত্মীয়-সনের বৌ দেখে ছিঃ ছিঃ করেছিল, বৌ-এর গুণের পরিচয় পেয়ে এখন তারা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রীমা স্বামীর সংসারে এত ব্যস্ত থাকলেও নিজের মা-বাবার কথা ভুলেনি। স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে তাদেরকে মাসিক বেশ কিছু টাকা সাহায্য করছে।
৩. আজ রীমাও স্বামী-শাশুড়ীর সঙ্গে
আজ রীমাও স্বামী-শাশুড়ীর সঙ্গে শ্বশুরকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছে। আর আরিফ আবসারের সনে দেখা করার জন্য তাদের বাসায় গিয়েছিল, সেও তাদের সঙ্গে এসেছে।
আবসার বাসায় চলে যাবার পর আরিফের পাশে একটা দাড়ি-টুপিওয়ালা ছেলে এসে বসল। আরিফ তাকে ঘটাখানেক আগে একজন রুগীকে নিয়ে হাসপাতালের ভিতর যেতে দেখেছিল। পাশে এসে বসার পর জিঞেস করল, আপনার রুগী কেমন আহে?
ছেলেটার নাম ফয়সাল। বলল, একই রকম।
এমন সময় একটা বেবী এসে গেটের কাছে থামতে সবার দৃষ্টি সেদিকে পড়ল। একজন বয়স্কা মেয়ে তাড়াতাড়ি বেবী থেকে নেমে হাসপাতালের ভিতরে ঢুকতে গিয়ে বাধা পেল।
দারোয়ান জিজ্ঞেস করল, ভিতরে কেন যাবেন? জানেন না, রুগী দেখার সময় বিকেল চারটেয়।
মেয়েটি বলল, আমি রুগী দেখতে আসিনি। আমার সাহেবের মেয়ে পায়খানা বমি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গেছে। তাকে নিয়ে এসেছি।
দারোয়ান বলল, সাহেবদের কেউ আসেনি?
মেয়েটি বলল, সাহেব গতকাল রাজশাহী গেছেন। তার আর কেউ নেই। দারোয়ান একবার বেবীর দিকে চেয়ে নিয়ে বলল, কারো সাহায্যে নিয়ে আসুন।
মেয়েটি নিরুপায় হয়ে যেখানে রুগীদের লোকজন বসে আছে, সেখানে এসে কাতরে বলল, আপনারা কেউ আমাকে সাহায্য করুন। আমার সাহেবের মেয়ে অজ্ঞান অবস্থায় বেবীতে রয়েছে।
সেখানে সব বয়সের অনেক মেয়ে-পুরুষ রয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে, যে মেয়েটি বেবীতে রয়েছে তার কলেরা হয়েছে। তাই কেউ কোন কথা না বলে একবার বেবীর দিকে আর একবার মেয়েটির দিকে চেয়ে দেখতে লাগল।
কেউ সাহায্য করতে আসছে না দেখে মেয়েটি আরো বেশি কাতরম্বরে বলল, আপনারা কেউ আসছেন না কেন? আপনাদের কারো মা-বোনের কলেরা হলে কি চুপ করে থাকতে পারতেন?
আরিফ এতক্ষণ দেখছিল, কেউ সাহায্য করতে যায় কিনা। এবার সে দাঁড়িয়ে ফয়সালের দিকে চেয়ে বলল, আসুন আমরা মেয়েটিকে সাহায্য করি।
ফয়সাল আরিফের কথায় সাড়া না দিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল।
আরিফ যা বোঝার বুকে গেল। মৃদু হেসে মেয়েটিকে বলল, চলুন আমি যাচ্ছি। তারপর বেবীর কাছে এসে রুগীকে দেখে মনে হোঁচট খেল। প্রথমে বয়স্কা মেয়েটিকে দেখে মনে করেছিল, কোন সাধারণ মধ্যবিত্ত সাহেবের বাড়ীতে কাজ করে। কিন্তু রুগীকে দেখে তার সে ভুল ভাঙল। এ যে কোটিপতির অপরূপ সুন্দরী মেয়ে। রুগীর মুখের চেহারায় ও পোশাকে উঁচু আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। আরিফ অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইল।
ততক্ষণে ঐ মেয়েটি বেবীর কাছে এসে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, আপনি একা কি পারবেন? আমি ধরছি বাবা।
আরিফ রুগীর রূপলাবণ্য দেখে বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। মেয়েটির কথায় বাস্তবে ফিরে এসে বলল, ইনশাআল্লাহ পারব। তারপর রুগীকে পাঁজাকোলা করে হাসপাতালের ভিতরে নিয়ে গিয়ে ডাক্তারের সামনের স্ট্রেচারে শুইয়ে দিল।
ঠিক সেই সময় রীমা স্বামীকে কিছু বলবে বলে গেটের দিকে আসছিল। একটা মেয়েকে আরিফ পাঁজাকোলা করে নিয়ে এসে স্ট্রেচারে শোয়াতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।
মেয়েটিকে শুইয়ে গিয়ে আরিফ যখন চলে যেতে উদ্যত হল তখন রীমার ডাক শুনতে পেল, আরিফ ভাই এদিকে একটু আসুন।
আরিফ রীমার কাছে গিয়ে বলল, খালুজান এখন কেমন আছেন?
: জ্ঞান ফিরেছে; তবে এখনো খিচুনী অল্প অল্প হচ্ছে। ডাক্তার পাউরুটি ও কলা খাওয়াতে বললেন। আপনার বন্ধুকে কিনে আনতে বলুন।
তাকে আমি কিছুক্ষণ আগে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। খেয়ে-দেয়ে আপনাদের ভাত নিয়ে আসবে।
রীমা একটা পঞ্চাশ টাকার নোট তার দিকে বাড়িয়ে বলল, তাহলে আপনি রুটি ও কলা নিয়ে আসুন। তার আগে বাইরের কলে হাত, পা ও মুখ ভাল করে ধুয়ে ফেলুন। আমি এখানে অপেক্ষা করছি।
আরিফ টাকা না নিয়ে বলল, ওটা রেখে দিন, আমার কাছে আছে। তারপর রীমা কিছু বলার আগে সে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল।
প্রায় পনের বিশ মিনিট পর রুটি-কলা কিনে এনে রীমার হাতে দিল।
রীমা বলল, আপনার বন্ধু তো কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়বেন। আপনার এখানে থাকার দরকার নেই। এক্ষুনি আপনি বাসায় গিয়ে সাবান দিয়ে গোসল করে খাওয়া দাওয়া করবেন। তারপর বিকেলের দিকে না হয় আসবেন। আর শুনুন, এই কাপড় চোপড় বাসায় গিয়ে লন্ড্রিতে পাঠিয়ে দেবেন।
আরিফ বলল, আবসার না আসা পর্যন্ত যাব না। আমি হোটেল থেকে খেয়ে এসে বাইরে থাকব। দরকার হলে ডাকবেন।