- বইয়ের নামঃ মানুষ অমানুষ
- লেখকের নামঃ কাসেম বিন আবুবাকার
- প্রকাশনাঃ খান পাবলিশার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. গ্রীষ্মের দুপুর
মানুষ অমানুষ- ইসলামিক উপন্যাস – কাসেম বিন আবুবাকার
গ্রীষ্মের দুপুর। প্রখর সূর্য-কিরণে ঢাকা শহরের পীচঢালা পথ তেতে আগুনের মত গরম হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও পীচ গলতে শুরু করেছে। অবশ্য তাতে শহরের লোকের চলাফেরার অসুবিধে হচ্ছে না। কারণ গরিব-ধনী সবার জন্য সব রকমের যানবাহন রয়েছে। নিতান্ত যাদের হাঁটা ছাড়া কোন উপায় নেই, তারাই শুধু হাঁটছে। তাও সবার পায়ে জুতো। তবে খালি পায়ে যে কেউ হাঁটছে না, তা নয়। তারা হল, ফকির-মীসকিন ও ঠেলাওয়ালাদের কিছু লোক।
বেলা তখন একটা। আরিফ মহাখালী কলেরা হাসপাতালের ভিতরের গেটের বাইরে বন্ধু আবসারের পাশে বসে আছে। গরমে গায়ের জামা-কাপড় ঘামে ভিজে যাচ্ছে। যেখানে রুগীদের লোকজন বসে অপেক্ষা করে, সেখানে কয়েকটা বেঞ্চ থাকলেও ফ্যান নেই। মেয়েদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা না থাকায়, একজায়গাতেই সবাই বসে আছে। এখানে যারা রয়েছে, তাদের কারো না কারো আত্মীয়ের ডাইরিয়া অথবা কলেরা হয়েছে।
এক সময় আরিফ আবসারকে বলল, তুই বাসায় গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে ভাবীর ও খালা-আম্মার ভাত নিয়ে আয়। চিন্তা করিস না, আমি তো আছি।
আবসার বলল, তাই যাই, যা গরম পড়েছে, আর একবার গোসলও করব। তারপর সে চলে গেল।
আজ ভোর থেকে আবসারের বাবা খায়ের সাহেবের বেশ কয়েকবার পাতলা পায়খানা ও বমি হয়েছে। বাসায় ডাক্তার এনে চিকিৎসা করানোর পরও যখন পাতলা পায়খানা ও বমি বন্ধ হল না তখন ডাক্তার মহাখালী কলেরা হাসপাতালে নিয়ে যাবার পরামর্শ দেন। কিন্তু খায়ের সাহেব রাজি হননি। বললেন, এই অসুখে আমার মৃত্যু লেখা থাকলে, হাসপাতালে নিয়ে গেলেও তা হবে। সেখানে ডাক্তার-নার্সদের হাতে আমি মরতে চাই না। শেষে বেলা এগারটার পর যখন পায়খানা ও বমি ঘন ঘন হতে লাগল এবং হাতে-পায়ে খিচুনী এসে গেল তখন বড় ছেলে আবসার ও তার স্ত্রী রীমা তাকে জোর করে হাসপাতালে নিয়ে আসে। সঙ্গে আবসারের মা আকলিমা বেগমও এসেছেন।
ভার্সিটিতে জুওলজীতে অনার্স পড়ার সময় আরিফের সঙ্গে আবসারের বন্ধুত্ব হয়। অনার্স পাস করে আবসার বাবাকে আর্থিক সাহায্য করার জন্য চাকরি করছে। আর আরিফ মাস্টার্স করছে।
খায়ের সাহেব গাইবান্ধার লোক। ঢাকায় একটা প্রাইভেট ফার্মে ভাল পোষ্টে আছেন। কিন্তু সৎ হওয়ার কারণে ফ্যামিলীসহ ঢাকায় থাকা এবং চার-পাঁচটা ছেলেমেয়ের পড়াশুনার খরচ চালাতে খুব হিমশিম খাচ্ছিলেন। আবসার চাকরিতে ঢুকতে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন।
আকলিমা বেগম হার্টের রুগী। আজকাল শহরে কাজের মেয়ে পাওয়া যায় না। কিশোরী, তরুণী ও যুবতীরা গার্মেন্টসে চাকরি করে। অসুস্থ শরীর নিয়ে আকলিমা বেগম সংসারের সব কাজ করেন। তাই খায়ের সাহেব আবসারের বিয়ে দিয়েছেন। আবসারের এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করার ইচ্ছা ছিল না। মায়ের জন্য একরকম করতে বাধ্য হয়েছে। তবে বাবা-মা বিয়ে দিলেও পাত্রী নিজে সিলেক্ট করেছে। অফিসে যাবার পথে প্রায় মেয়েটির সাথে আবসারের দেখা হত। কোন কোন দিন ফেরার সময় তাকে তাদের বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখত। তখন আবসারের মনে হত, মেয়েটি যেন তাকে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। কয়েক বার চোখে চোখও পড়েছে। প্রথম দিন আবসার লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে হাঁটতে থাকে। কিছু দূর আসার পর আবসারের মনে হল, মেয়েটি তার দিকে চেয়ে আছে। অনুমানটা যাচাই করার জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, সত্যিই তাই। আবসার ঘাড় ফিরিয়ে নিয়ে চলে আসে। কয়েক বছর কলেজ-ভার্সিটিতে পড়লেও কোন মেয়েকে নিয়ে তেমন কিছু ভাবেনি। অফিসে জয়েন করার পর এই মেয়েটা তাকে মাঝে মাকে ভাবায়। মেয়েটার গায়ের রং ফর্সা হলেও ফেস কাটিং ভাল নয়। চোখ দুটো কেমন ভাসা ভাসা-নাক চেপটা-ঠোঁট মোটা। তবে শরীরের বাঁধন ভাল, সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা, দোহারা শরীর। সর্বোপরি তার উন্নত বক্ষ দুটো দারুণ। হাঁটার সময় ভারী নিতম্বের উত্থান-পতন যে কোন বয়সের পুরুষের মনকে নাড়া দেয়। বন্ধু আরিফের কাছে শুনেছে, যে সব মেয়েদের ফেসকাটিং খারাপ কিন্তু দেহের গঠন ভাল, তারা সাধারণত ঠাণ্ডা মেজাজের হয়, এবং খুব স্বামীভক্ত হয়। মেয়েটিকে দেখার পর থেকে আবসারের প্রায় মনে হয়, একে বিয়ে করলে মন্দ হয় না। আবার চিন্তা করে, এরকম মেয়েকে কি মা-বাবা পছন্দ করবে? একদিন অফিসে যাবার সময়ে এইসব ভাবতে ভাবতে একসময় নিজে নিজে শব্দ করে হেসে উঠল।
একজন বয়স্ক পথিক পাশ দিয়ে যাবার সময় আবসারের হাসি শুনে জিজ্ঞেস করলেন, কি হল দাদু, একা একা হাসছেন যে?
আবসার লজ্জা পেয়ে হাসি থামিয়ে বলল, না দাদু, কিছু হয়নি, একটা হাসির কথা মনে পড়ল, তাই হাসলাম।
পথিক বললেন, এখনই তো আপনাদের হাসবার বয়স।
আবসার আর কিছু না বলে হাঁটতে শুরু করল।
এভাবে ছয় মাস কেটে গেল। একদিন আকলিমা বেগম আবসারকে বললেন, এই শরীর নিয়ে আমি আর তোদের সংসার টানতে পারছি না। তুই এবার বিয়ে কর। মায়ের কথা শুনে আবসার চিন্তা করল, চাকরি করে বাবাকে সাহায্য করছি, বিয়ে করে একটা মেয়েকে আনলে মাকেও সাহায্য করা হবে। তখন তার ঐ মেয়েটির কথা মনে পড়ল। একদিন মেয়েটির ব্যাপারে আলাপ করার জন্য আরিফের বাসায় গেল।