ভাবি।…
আমার গায়ে হাত দিয়ে বল, ভাবি। ওগো আমার গায়ে হাত দিয়ে বল।…
আমি একটা ঘোরের মধ্যে আছি। সবটাই মনে হচ্ছে স্বপ্ন। স্বপ্নে সবই সস্তুব। আমি মেয়েটির গা স্পর্শ করবার জন্যে এগুলাম, তখনি আমার মৃতা মা উঠোন থেকে চোঁচালেন–খবরদার সুধাকান্ত, খবরদার! …
আমার ঘোর কেটে গেল। এ আমি কী করছি ? এ আমি কী করছি? আমি হাতে ধরে রাখা হারিকেন ছুড়ে ফেলে ছুটে ঘর থেকে বেরুতে গেলাম। খাটের উপর বসেথাকা মেয়েটি পিছন থেকে আমার উপর, ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমার ডান পায়ের গোড়ালি কামড়ে ধরল। ভয়াবহ কামড়া মনে হল পায়ের হাড়ে সে দাঁত ফুটিয়ে দিয়েছে।–
সে হাত দিয়ে আমাকে ধরুল না। কামড়ে ধরে রাখল। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করলাম বেরিয়ে যেতে। কিছুতেই পারলাম না। এতটুকু একটা মেয়ে-কী প্ৰচণ্ড তার শক্তি! আমি প্ৰাণপণে চৌচালাম-কে কোথায় আছ, বাঁচাও। আমাকে বাঁচাও। আমাকে বাঁচাও। তখন একটা ব্যাপার ঘটল। মনে হল কালো একটা কী-যৌন উঠোন থেকে ঘরের ভিতর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঝাঁপিয়ে পড়ল, মেয়েটির উপর। চাপা গর্জন শোনা যেতে লাগল। মেয়েটি আমাকে ছেড়ে দিল! আমি পা টানতে-টানতে উঠোনে চলে এলাম।…
উঠোনে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলাম ভিতরে ধস্তাধস্তি হচ্ছে। ধস্তাধস্তি হচ্ছে ঐ পাগলা কুকুর এবং মেয়েটার মধ্যে। মেয়েটা তীব্র গলায় বলছে–ছাড়, আমাকে ছাড়।…
কুকুরটা ক্রুদ্ধ গর্জন করছে। সেই গর্জন ঠিক কুকুরের গর্জনও নয়। অদেখা ভুবনের কোনো পশুর গর্জন। সেই গর্জন ছাপিয়েও মেয়েটির গলার স্বর শোনা যাচ্ছে—আমারে খাইয়া ফেলতাছে। ওগো তুমি কই? আমারে খাইয়া ফেলতাছে।
সুধাকান্তবাবু থামলেন।
আমি বললাম, তারপর?
তিনি জবাব দিলেন না। আমি আবার বললাম, তারপর কী হল সুধাকান্তবাবু?
তিনি আমার দিকে তাকালেন। যেন আমার প্রশ্নই বুঝতে পারছেন না। আমি দেখলাম তিনি থরথর করে কাঁপছেন। আমি বললাম, কী হল সুধাকান্তবাবু?
তিনি কাঁপা গলায় বললেন, ভয় লাগছে। দেয়াশলাইটা একটু জ্বালান তো!
আমি দেয়াশলাই জ্বাললাম। সুধাকান্তবাবু তাঁর পা বের করে বললেন, দেখুন, কামড়ের দাগ দেখুন।
আমি গভীর ক্ষতচিহ্নের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সুধাকান্তবাবু বললেন, ও এখনো আসে। বাড়ির পিছনে থপথপ করে হাঁটে নিঃশ্বাস ফেলে। জানালার পাট হঠাৎ করে বন্ধ করে দিয়ে ভয় দেখায়। হাসে। নাকী সুরে কাঁদে। একেক দিন খুব বিরক্ত করে। তখন ঐ কুকুরটাও আসে। হুটোপুটি শুরু হয়ে যায়। সাধারণত কৃষ্ণপক্ষের রাতেই বেশি হয়।
আমি বললাম এটা কি কৃষ্ণপক্ষ?
সুধাকান্তবাবু বললেন, না। চাঁদ দেখতে পাচ্ছেন না?
আমি বললাম, আপনি তো তাই ভয়াবহ গল্প শোনালেন। আমি তো এখন রাতে ঘুমুতে পারব না।
ঘুমানর দরকার নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে সূৰ্য উঠবে। চাঁদ ডুবে গেছে দেখছেন না?
আমি ঘড়ি দেখলাম। চারটা বাজতে কুড়ি মিনিট। সত্যি-সত্যি রাত শেষ হয়ে গেছে।
সুধাকান্তবাবু বললেন, চা খাওয়া যাক, কি বলেন?
হ্যাঁ, খাওয়া যাক।
তিনি চুলা ধরিয়ে কেটলি বসিয়ে দিয়ে নিচু গলায় বললেন, বড়ো বিরক্ত করে। মাঝে-মাঝে টিল মারে টিনের চালে, থু-থু করে থুথু ফেলে। ভয় করে। রাতবিরাতে বাথরুমে যেতে হলে হাতে জ্বলন্ত আগুন নিয়ে যেতে হয়। গলায় এই দেখুন। একটা অষ্টধাতুর কবচ। কোমরে সবসময় একটা লোহার চাবি বাঁধা, তবু ভয় কাটে না।
বাড়ি ছেড়ে চলে যান না কেন?
কোথায় যাব বলেন? পূর্বপুরুষের ভিটে।
কাউকে সঙ্গে এনে রাখেন না কেন?
কেউ থাকতে চায় না রে ভাই, কেউ থাকতে চায় না।
সুধাকান্তবাবু চায়ের কাপ হাতে তুলে দিলেন। চুমুক দিতে যাব, তখনি বাড়ির একটা কপাট শব্দ করে নড়ে উঠল। আমি চমকে উঠলাম। হাওয়ার কোনো বংশও নেই-কপাটে শব্দ হয় কেন?
আমি সুধাকান্তবাবুর দিকে তাকালাম। তিনি সহজ গলায় বললেন, ভয়ের কিছু নেই-চা খান। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোর হবে।
বাড়ির পিছনের বনে খচমচ শব্দ হচ্ছে। আসলে আমি অস্থির বোধ করছি। এই অবস্থা হবে জানলে কে আসত এই লোকের কাছে! আমার ইচ্ছে করছে ছুটে পালিয়ে যাই। সুধাকান্তবাবু বললেন, ভয় পাবেন না।
আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি একমনে মন্ত্র আওড়াতে লাগলেন। নিশ্চয়ই ভূত-তাড়ান মন্ত্র। আমি খুব চেষ্টা করলাম ছোটবেলায় শেখা আয়াতুল কুরসি মনে করতে। কিছুতেই মনে পড়ল না। মাথা পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে গেছে। গাঁ দিয়ে ঘাম বেরুচ্ছে। ঠিকমতো নিঃশ্বাসও নিতে পারছি না। মনে হচ্ছে বাতাসের অক্সিজেন হঠাৎ করে অনেকখানি কমে গেছে। ভয় নামক ব্যাপারটি যে কত প্রবল এবং কী-রকম সর্বগ্রাসী, তা এই প্রথম বুঝলাম।
একসময় ভোর হল। ভোরের পাখি ডাকতে লাগল। আকাশ ফর্স্যা হল! তাকিয়ে দেখি গায়ের পাঞ্জাবি ভিজে জবজব করছে।
মামাতো ভাইয়ের বিয়ে
আমার মামাতো ভাইয়ের বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হল না। মেয়ে কিছুতেই কবুল বলল না। যত বার বলা হল, মা, বল কবুল।
তত বারই মেয়ে কঠিন গলায় বলল, না।
আমি ছেলের পক্ষের সাক্ষীদের এক জন। বড় বিব্রত বোধ করতে লাগলাম! মেয়ের এক খালা বললেন, আপনারা একটু পরে আবার আসুন। বাড়িতে এত বড় একটা দুৰ্ঘটনা ঘটেছে। মনটন খারাপ। বুঝতেই পারছেন।
আমরা চলে এলাম। ঘন্টাখানেক পর আবার গেলাম। বলা হল, মা, বল তো কবুল। মেয়েটি অস্ফুট গলায় কী-যেন বলল। মেয়ের খালা বললেন, এই তো বলেছে। মেয়েমানুষ চিৎকার করে বলবে নাকি? আমি শুনেছি, পরিষ্কার বলেছে। এখন যান, ছেলের কবুল নিয়ে আসুন!