আপনি আবার ভয় পেলেন?
না, ভয় পেলাম না। একবার ভয় কেটে গেলে মানুষ চট করে আর ভয় পায় না। আমি এগিয়ে গেলাম!
কুকুরটা তখনো আছে?
হ্যাঁ, আছে।
তারপর বলুন।
কাছাকাছি। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম একটা মেয়ের ডেডবিডি। এগার-বার বছর বয়স। পরনে ডোরাকাটা শাড়ি।
বলেন কী আপনি!
যা দেখলাম তাই বলছি।
মেয়েটা যে মরে আছে তা বুঝলেন কী করে?
যে-কেউ বুঝবে। মেয়েটা মরে শক্ত হয়ে আছে। হাত মুঠিবদ্ধ করা। মুখের কষে রক্ত জমে আছে।
কী সৰ্ব্বনাশ!
ভয় পেলেন না?
না, ভয় পেলাম না! আপনাকে তো আগেই বলেছি, একবার ভয় পেলে মানুষ দ্বিতীয় বার চট করে ভয় পায় না।
তারপর কী হল বলুন।
মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। বাচ্চা একটা মেয়ে এইভাবে মরে পড়ে আছে, কেউ জানছে না। কীভাবে না জানি বেচারি মরল। ড়েড়বডি এখানে ফেলে রেখে যেতে ইচ্ছা করল না। ফেলে রেখে গেলে শিয়াল-কুকুরে ছিঁড়ে খুঁড়ে খাবে। আমার মনে হল এই মেয়েটাকে নিয়ে যাওয়া উচিত।
আশ্চর্য তো।
আশ্চর্যের কিছু নেই। আমার অবস্থায় পড়লে আপনিও ঠিক তাই করতেন।
না, আমি তা করতাম না। চিৎকার করে লোক ডাকাডাকি করতাম।
আশেপাশে কোনো বাড়িঘর নেই। কাকে আপনি ডাকতেন?
তারপর কী হল বলুন।
সুধাকান্তবাবু বললেন, আপনি আমাকে একটা সিগারেট দিন। সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে।
আমি সিগারেট দিলাম। বৃদ্ধ সিগারেট ধরিয়ে খিকখিক করে কাশতে লাগলেন।
আমি বললাম, তারপর কী হল বলুন।
সুধাকান্তবাবু বললেন, ঘটনাটা এখানে শেষ করে দিলে কেমন হয়? আমার কেন জানি আর বলতে ইচ্ছা করছে না।
ইচ্ছে না করলেও বলুন। এখানে গল্প শেষ করার প্রশ্নই ওঠে না।
এটা গল্প না।
গল্প না যে তা বুঝতে পারছি। তারপর বলুন আপনি কী করলেন। মেয়েটাকে তুললেন?
হাঁ তুললাম। কেন তুললাম সেটাও আপনাকে বলি। একটা অপরিচিত মেয়ের শবদেহ কেউ চট করে কোলে তুলে নিতে পারে না। আমি এই কাজটা করলাম, কারণ এই বালিকার মুখ দেখতে অবিকল …
সুধাকান্তবাবু থেমে গেলেন। আমি বললাম, মেয়েটি দেখতে ঐ মেয়েটির মতো, যার সঙ্গে আপনার বিয়ের কথা হয়েছিল। আরতি?
হা, আরতি। আপনার স্মৃতিশক্তি তো খুব ভালো।
আপনি আপনার গল্পটা বলে শেষ করুন।
মেয়েটি দেখতে অবিকল আরতির মতো। আমি মাটি থেকে তাকে তুললাম। মরা মানুষের শরীর ভারি হয়ে যায়, লোকে বলে! আমি দেখলাম মেয়েটার শরীর খুব হালকা। একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, মেয়েটাকে তোলার সঙ্গে-সঙ্গে চিৎকার বন্ধ করে দিল। আমার কাছে মনে হল চারদিক হঠাৎ যেন অস্বাভাবিক নীর হয়ে গেছে। আমি মেয়েটাকে নিয়ে রওনা করলাম।
আপনার ভয় করল না?
না, ভয় করে নি। মেয়েটার জন্যে মমতা লাগছিল। আমার চোখে প্রায় পানি এসে গিয়েছিল। কার-না-কার মেয়ে, কোথায় এসে মরে পড়ে আছে। বাড়িতে এসে পৌঁছলাম। মনে হচ্ছে নিশুতি রাত! আমি কোলে করে একটা মৃতী বালিকা নিয়ে এসেছি, অথচ আমার মোটেও ভয় করছে না! আমি মেয়েটিকে ঘাড়ের উপর শুইয়ে রেখেই তালা খুলে ঘরে ঢুকলাম। তখন কেন জানি বুকটা কেঁপে উঠল। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল। আমি ভাবলাম ঘর অন্ধকার বলেই এ-রকম হচ্ছে, আলো জ্বললেই ভয় কেটে যাবে। মেয়েটাকে আমি বিছানায় শুইয়ে দিলাম। …
খাটের নিচে হারিকেন থাকে। আমি হারিকেন বের করলাম। ভয়টা কেন জানি ক্রমেই বাড়তে লাগল। মনে হল ঘরের বাইরে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে আমার কাণ্ডকারখানা দেখছে। যেন আমার সমস্ত আত্মীয়স্বজনরা চলে এসেছে। আমার বাবা, আমার ঠাকুরদা, আমার ছোটপিস-কেউ বাদ নেই। ওরা যে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করছে, তাও আমি শুনতে পাচ্ছি।…
হারিকেন জ্বালাতে অনেক সময় লাগল। হাত কেঁপে যায়। দেশলাইয়ের কাঠি নিতে যায়, সালতায় আগুন ধরতে চায় না। টপটপ করে আমার গা দিয়ে ঘাম ঝরছে। শেষ পর্যন্ত হারিকেন জ্বলিল। আমার নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল। আমি খাটের দিকে তাকলাম-এটা আমি কী দেখছি! এটা কি সম্ভব? এ-সব কী? আমি দেখলাম, মেয়েটা খাটের উপর বসে আছে। বড়-বড় চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার পায়ের নিচের মাটি কেঁপে উঠল। মনে হল মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছি। …
স্পষ্ট শুনলাম উঠোন থেকে ভয়ার্ত গলায় আমার বাবা ডাকছেন, ও সুধাকান্ত, ও সুধাকান্ত, তুই বেরিয়ে আয় ও সুধাকান্ত, তুই বেরিয়ে আয় ও ব্যাপাধন, বেরিয়ে আয়।…
আমি বেরিয়ে আসতে চাইলাম, পারলাম না। পা যেন মাটির সঙ্গে গেঁথে গেছে। সমস্ত শরীর পাথর হয়ে গেছে। আমি মেয়েটির উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারলাম না। মেয়েটি একটু যেন নড়ে উঠল। কিশোরীদের মতো নরম ও কোমল গলায় একটু টেনে-টেনে বলল, তুমি এক-একা থাক। বড়ো মায়া লাগে গো! কত বার ভাবি তোমারে দেখতে আসব। তুমি কি আমারে চিনতে পারছ? আমি আরতি গো, আরতি। তুমি কি আমারে চিনছ?…
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো বললাম, হ্যাঁ। …
তোমার জন্যে বড় মায়া লাগে গো, বড় মায়া লাগে। এক-একা তুমি থাক। বড় মায়া লাগে! আমি কত ভাবি তোমার কথা। তুমি ভাব না?…
আমার মনে হল বাড়ির উঠোনে আমার সমস্ত মৃত আত্মীয়স্বজন ভিড় করেছে। আট বছর বয়সে আমার একটা বোন পানিতে পড়ে মারা গিয়েছিল। সেও ব্যাকুল হয়ে ডাকছে–ও দাদা, তুই বেরিয়ে আয় দাদা। আমার ঠাকুরমার ভাঙা-ভাঙা গলাও শুনলাম-ও সুধাকান্ত, সুধাকান্ত। …
খাটের উপর বসে-থাকা মেয়েটা বলল, তুমি ওদের কথা শুনতেছ কেন গো? এত দিন পরে তোমার কাছে আসলাম। আমার মনটা তোমার জন্যে কান্দে। ওগো, তুমি আমার কথা ভাব না? ঠিক করে বল—ভাব না?…