কী দুর্ঘটনা?
সাপের কামড়। আমাদের এই অঞ্চলে সাপের উপদ্রব আছে। বিশেষ করে কেউটে সাপ
তারপর কী হল বলুন।
মেয়েটির মৃত্যুতে খুব শোক পেলাম। প্রায় মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল। কিছুই ভালো লাগে না। রাতবিরাতে শ্মশানে গিয়ে বসে থাকি। সমাজ-সংসার কিছুতেই মন বসে না। গভীর বৈরাগ্য। কিছুদিন সাধু-সন্ন্যাসীর খোঁজ করলাম। ইচ্ছা ছিল উপযুক্ত গুরুর সন্ধান পেলে মন্ত্র নেব! তেমন কাউকে পেলাম না।
আমার বাবা অন্যত্র আমার বিবাহের চেষ্টা করলেন। আমি রাজি হলাম না। বাবাকে বুঝিয়ে বললাম যে, ঈশ্বরের ইচ্ছা না যে আমি সংসারের বন্ধনে আটকা পড়ি। পরিবারের অন্যরাও চেষ্টা করলেন–আমি সম্মত হলাম না। এ-সব আমার প্রথম যৌবনের কথা। না-বললে আপনি গল্পটা ঠিক বুঝতে পারবেন না। আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন?
আমি বললাম, না, বিরক্ত হব কেন?
সুধাকান্তবাবু বললেন, প্রথম যৌবনের কথা সবাই খুব আগ্রহ করে বলে। আমি বলতে পারি না।
আপনি তো ভালোই বলছেন। থামবেন না—বলতে থাকুন।
সুধাকান্তবাবু আবার শুরু করলেন—
এরপর অনেক বছর কাটল। শ্মশানে-শ্মশানে ঘুরতাম বলেই বোধহয় ঈশ্বর আমার ঘরটাকেই শ্মশান করে দিলেন। পুরোপুরি একা হয়ে গেলাম। মানুষ যে-কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেয়। আমিও মানিয়ে নিলাম। আমার প্রকৃতির মধ্যে একধরনের একাকীত্ব ছিল, কাজেই আমার খুব অসুবিধা হল না। এখন আমি মূল খলমুলুমসব তার আগে আপনি কি খাবেন?
জ্বি-না।
খান একটু চা, ভালো লাগবে।
আমার মনে হল ভদ্রলোকের নিজেরই চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে! আমি বললাম, ঠিক আছে, বানান। একটু ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা লাগছে অবশ্যি।
ভিতরে গিয়ে বসবেন?
জ্বি-না, এখানেই ভালো লাগছে।
চা শেষ করার পর দ্বিতীয় দফায় গল্প শুরু হল। এইখানে আমি একটা মজার ব্যাপার লক্ষ করলাম। আমার কাছে মনে হল ভদ্রলোকের গলার স্বর পান্টে গেছে। আগে যে-স্বরে কথা বলছিলেন, এখন সেই স্বরে বলছেন না! একটা পরিবর্তন হয়েছে। আমার মনের ভুল হতে পারে। অনেক সময় পরিবেশের কারণে সবকিছু অন্য রকম মনে হয়।
ধাকান্তবাবু বলতে শুরু করলেন—
গত বৎসরের কথা। কার্তিক মাস। আমি বাড়িতে ফিরছি। রাত প্রায় দশটা কিংবা তার চেয়ে বেশিও হতে পারে। আমার ঘড়ি নেই, সময়ের হিসাব ঠিক থাকে না।
আমি সুধাকান্তবাবুকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার স্কুল তো নিশ্চয়ই চারটা-পাঁচটার দিকে ছুটি হয়। এত রাতে ফিরছিলেন কেন?
সুধাকান্তবাবু নিচু গলায় বললেন, রোজই এই সময়ে বাড়ি ফিরি। সকাল-সকল বাড়ি ফেরার কোনো উৎসাহ বোধ করি না। পাবলিক লাইব্রেরি আছে, ঐখানে পত্রিকাটত্রিকা পড়ি, গল্পের বই পড়ি।
বলুন তারপর কী হল।
তারিখটা হচ্ছে বারই কীৰ্তিক, সোমবার। আমি মানুষ হিসাবে বেশ সাহসী। রাতবিরাতে এক-একা ঘোরাফেরা করি। ঐ রাতে রাস্তায় নেমেই আমার ভয়ভয় করতে লাগল। কী জন্যে ভয় করছে সেটাও বুঝলাম না। তখন মনে হল–রাস্তায় একটা পাগলা কুকুর বের হয়েছে, ভয়টা বোধহয় ঐ কুকুরের কারণে। আমি একটা লাঠি হাতে নিলাম। …
শুক্লপক্ষের রাত। ফক্ফকা জ্যোৎস্না, তবু পরিষ্কার সবকিছু দেখা যাচ্ছে না। কারণ কুয়াশা। কাৰ্তিক মাসের শেষে এদিকে বেশ কুয়াশা হয়। …
নদীর কাছাকাছি আসতেই কুকুরটাকে দেখলাম। গাছের নিচে শুয়ে ছিল। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়াল এবং পিছনে-পিছনে আসতে লাগল। মাঝে-মাঝে চাপা। শব্দ করছে। পাগলা কুকুর পিছনে-পিছনে আসছে, আমি এগুচ্ছি।–ব্যাপারটা খুব ভয়াবহ। যে-কোনো মুহূর্তে এই কুকুর ছুটে এসে কামড়ে ধরতে পারে। কুকুরটাকে তাড়াবার চেষ্টা করলাম। টিল ছুড়লাম, লাঠি দিয়ে ভয় দেখলাম। কুকুর নড়ে না, দাঁড়িয়ে থাকে। চাপা শব্দ করতে থাকে। আমি হাঁটতে শুরু কললেই সেও হাঁটতে শুরু করে। …
যাই হোক, আমি কোনোক্রমে নদীর পাড়ে এসে পৌঁছলাম। তখন আমার খানিকটা সাহস ফিরে এল। কারণ, পাগলা কুকুর পানিতে নামে না। পানি দেখলেই এরা ছুটে পালায়। …
।অদ্ভুত কাণ্ড, কুকুর পানি দেখে ছুটে পালাল না! আমার পিছন-পিছন নেমে পড়ল। আমার বিশ্বয়ের সীমা রইল না। …
আমি নদীর ও-পারে উঠলাম। কুকুরটাও উঠল—আর ঠিক তখন একটা ব্যাপার ঘটল।
সুধাকান্তবাবু থামলেন।
আমি বিরক্ত গলায় বললাম, আপনি জটিল জায়গাগুলিতে দয়া করে থামবেন না। গল্পের মজা নষ্ট হয়ে যায়।
সুধাকান্তবাবু বললেন, এটা কোনো গল্প না। ঘটনাটা কীভাবে বলব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না বলে থেমেছি।
আপনি মোটামুটিভাবে বলুন, আমি বুঝে নেব।
কুকুরটা আমার খুব কাছাকাছি চলে এল। পাগলা কুকুর আপনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। কিনা জানি না। ভয়ংকর দৃশ্য! সারাক্ষণ হাঁ করে থাকে। মুখ দিয়ে লালা পড়ে, চোখের দৃষ্টিটাও অন্য রকম। আমি ভয়ে কাঠ হয়ে গেছি। ছুটে পালাব বলে ঠিক করেছি, ঠিক তখন কুকুরটা কেন জানি ভয় পেয়ে গেল। অস্বাভাবিক ভয়। একবার এ—দিকে যাচ্ছে, একবার ও-দিকে যাচ্ছে। চাপা আওয়াজটা তার গলায় আর নেই। সে ঘেউঘেউ করছে। আমার কাছে মনে হল, সে কুকুরের ভাষায় আমাকে কী যেন বলার চেষ্টা করছে। এ-রকম চলল মিনিট পাঁচেক, তার পরই সে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সাঁতরে ও—পারে চলে গেল। পুরোপুরি কিন্তু গেল না, ও-পারে দাঁড়িয়ে রইল এবং ক্ৰমাগত ডাকতে লাগল।
তারপর?
আমি একটা সিগারেট ধরলাম! তখন আমি ধূমপান করতাম। মাস তিনেক হল ছেড়ে দিয়েছি। যাই হোক, সিগারেট ধরাবার পর ভয়টা পুরোপুরি কেটে গেল। হাত থেকে লাঠি ফেলে দিলাম। বাড়ির দিকে রওনা হব বলে ভাবছি, হঠাৎ মনে হল নদীর ধার ঘেষে বড়ো-হওয়া ঘাসগুলোর মাঝখান থেকে কী- একটা যেন নড়ে উঠল।