আমি মনে-মনে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম। পৃথিবী কোথায় চলে গিয়েছে–এই বৃদ্ধ তা বোধহয় জানে না! চাঁদের পিঠে মানুষের জুতোর ছাপ পড়েছে, ভাইকিং উপগ্রহ নেমেছে মঙ্গলের মরুভূমিতে, ভয়েজার ওয়ান এবং টু উড়ে গেছে বৃহস্পতির কিনারা ঘেষে, আর এই অঙ্কের শিক্ষক ভূতের ভয়ে ঘরে আগুন জ্বালিয়ে রাখছে। কারণ, অশরীরীরা আগুন ভয় পায়।
আমি বললাম, আপনি কি ওদের দেখেছেন কখনো?
না।
ওদের পায়ের শব্দ পান?
তাও না।
তাহলে?
বুঝতে পারি।
বুঝতে পারেন?
জ্বি। আপনি যখন আছেন, আপনিও বুঝবেন।
ওদের কাণ্ডকারখানা দেখতে পাব, তাই বলছেন?
হুঁ, তবে ওদের না, এক জন শুধু আসে।
তাও ভালো যে এক জন আসে। আমি ভেবেছিলাম দলবল নিয়ে বোধহয় চলে আসে। নাচ গান হৈ-হল্লা করে।
আপনি আমার কথা একেবারেই বিশ্বাস করছেন না?
ঠিকই ধরেছেন, বিশ্বাস করছি না। অবশ্য এই মুহূর্তে আমার গা ছমছম করছে। কারণ, আপনার পরিবেশটা ভৌতিক।
সুধাকান্তবাবু বললেন, ওরা কিন্তু আছে।
আমি চুপ করে রইলাম। এই বৃদ্ধের সঙ্গে ভূত আছে কি নেই, তা নিয়ে তর্ক করার কোনো অর্থ হয় না! থাকলে থাকুক।
আমার কাছে যে আসে, সে একটা মেয়ে।
তাই নাকি?
জ্বি, এগার-বার বছর বয়স।
বুঝলেন কী করে তার বয়স এগার-বার? আপনাকে বলেছে?
জ্বি-না! অনুমান করে বলছি।
তার নাম কি? নাম জানেন?
জ্বি-না।
সে এসে কী করে?
সুধাকান্তবাবু বললেন, মেয়েটি যে আসছে এই কি যথেষ্ট নয়? তার কি আর কিছু করার প্রয়োজন আছে?
আমি চুপ করে গেলাম। আসলেই তো, অশরীরী এক বালিকার উপস্থিতিই তো যথেষ্ট। সুধাকান্তবাবু বললেন, আপনি নিজেও হয়তো দেখতে পারবেন! আমি চমকে উঠলাম। ভদ্রলোক সহজ স্বরে বললেন, আমি ছাড়াও অনেকে দেখেছে।
সুধাকান্তবাবু ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন এবং তার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে বিকট একটা হাসি শুনলাম। উঠোন কাঁপিয়ে গাছপালা কাঁপিয়ে হো-হো করে কে যেন হেসে উঠল। সুধাকান্তবাবু পাশে না থাকলে অজ্ঞানই হয়ে যেতাম। আমি তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠলাম, কে, কে?
সুধাকান্তবাবু বললেন, ওটা কিছু না।
আমি ভয়-জড়ানো গলায় বললাম, কিছু না মানে?
ওটা খাটাশ। মানুষের মতো শব্দ করে হাসে।
বলেন কী! খাটাশের নাম তো এই প্রথম শুনলাম! এ তো ভূতের বাবা বলে মনে হচ্ছে! এখনো আমার গা কাঁপছে।
জল খান। জল খেলে ভয়টা কমবে।
সুধাকান্তবাবু কাঁসার গ্লাসে করে পানি নিয়ে এলেন। খাটাশ নামক জন্তুটি আরেক বার রক্ত হিম-করা হাসি হাসল। সুধাকান্তবাবু যদি কিছু না বলতেন তাহলে ভূতের হাসি শুনেছি, এই ধারণা সারা জীবন আমার মনের মধ্যে থাকত।
লোকটার প্রতি এই প্ৰথম আমার খানিকটা আস্থা হল। আজগুবি গল্প বলে ভয় দেখান এই লোকের ইচ্ছা নয় বলেই মনে হল। এ-রকম ইচ্ছা থাকলে, এই ভয়ংকর হাসির কারণ সম্পর্কে সে চুপ করে থাকত।
সুধাকান্তবাবু বললেন, ঐ মেয়েটার কথা শুনবেন?
হ্যাঁ, শোনা যেতে পারে। তবে আমি নিজে অবিশ্বাসী ধরনের মানুষ, কাজেই গল্পের মাঝখানে যদি হেসে ফেলি কিছু মনে করবেন না।
এই গল্পটা কাউকে বলতে ভালো লাগে না। অবশ্যি অনেককে বলেছিা! এখানকার সবাই জানে।
আপনার গল্প এখানকার সবাই বিশ্বাস করেছে?
সুধাকান্তবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, আমি যদি এখানকার কাউকে একটা মিথ্যা কথাও বলি, এরা বিশ্বাস করবে। এরা আমাকে সাধুবাবা বলে ডাকে। আমি আমার এই দীর্ঘ জীবনে কোনো মিথ্যা কথা বলেছি বলে মনে পড়ে না। আমি থাকি এক-একা। আমার প্রয়োজনও সামান্য। মানুষ মিথ্যা কথা বলে প্রয়োজন এবং স্বার্থের কারণে। আমার সেই সমস্যা নেই। এইসব থাক, আমি বরং গল্পটি বলি।
বলুন।
ভেতরে গিয়ে বসবেন? এখানে মনে হচ্ছে একটু ঠাণ্ডা লাগছে। অগ্রহায়ণ মাসে হিম পড়ে।
আমার অসুবিধা হচ্ছে না, এখানেই বরং ভালো লাগছে। গ্রামে তেমন আসা হয় না। আপনি শুরু করুন।
সুধাকান্তবাবু গল্প শুরু করতে গিয়েও শুরু করলেন না; হঠাৎ যেন একটু অন্য রকম হয়ে গেলেন। যেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছু দেখতে চেষ্টা করছেন। খসখস শব্দ হল। নতুন কাপড় পরে হাঁটলে যেমন শব্দ হয়, সে-রকম। তার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই কাঁচের চুড়ির টুং-টুং শব্দের মতো শব্দ। আমি বললাম, কী ব্যাপার বলুন তো?
সুধাকান্তবাবু ফ্যাকাসে মুখে হাসলেন। আমি বললাম, কিসের শব্দ হল?
তিনি নিচু গলায় বললেন, ও কিছু না, আপনি গল্প শুনুন। আজ ঘুমিয়ে কাজ নেই, আসুন গল্প করে রাত পার করে দিই।
গা-ছিমছমে পরিবেশ। বাড়ির লাগোয়া ঝাঁকড়া কামিনী গাছ থেকে কামিনী ফুলের নেশা-ধরান গন্ধ আসছে। কুয়ার আশেপাশে অসংখ্য জোনাকি জ্বলছে–নিভছে। উঠোনের চুলা থেকে ভেসে আসছে পোড়া কাঠের গন্ধ। আকাশ-ভরা নক্ষত্ৰবীথি।
সুধাকান্তবাবু গল্প শুরু করলেন।
সাধুবাবা
যুবক বয়স থেকেই আমাকে সবাই ডাকত সাধুবাবা। . . . .
যদিও ঠিক সাধু বলতে যা বোঝায় আমি তী নই। তবে প্রকৃতিটা একটু ভিন্ন ছিল। সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে-দূরে রাখার স্বভাব আমার ছিল। শ্মশান, কবরস্থান এইসব আমাকে ছোটবেলা থেকেই আকর্ষণ করত। অল্প বয়স থেকেই শ্মশান এবং কবরস্থানের আশেপাশে ঘুরঘুর করতাম। আমার বাবা শ্যামাকান্ত স্ট্রেমিক তখন জীবিত। আমার মতিগতি দেখে অল্প বয়সেই আমার বিবাহ ঠিক করলেন। পাশের গ্রামের মেয়ে। ভবানী মিত্ৰ মহাশয়ের প্রথমা কন্যা আরতি। খুবই রূপবতী মেয়ে। গ্রামাঞ্চলে এ-রকম মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না। আমি বিবাহ করতে রাজি হলাম! কথাবার্তা পাকাপার্কি হয়ে যাবার পর একটা দুর্ঘটনায় মেয়েটা মারা যায়।