আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। এ কী সমস্যা! বাকি পথ দু জন নীরবে পার হলাম!
পুরোপুরি নীরব বলাটা বোধহয় ঠিক হল না। ভদ্রলোক নিজের মনেই মাঝেমাঝে বিড়বিড় করছিলেন। মন্ত্রটন্ত্র পড়ছেন বোধহয়।
ভদ্রলোকের বাড়ি একেবারে জঙ্গলের মধ্যে। একতলা পাকা দালান। প্রশস্ত উঠেন। উঠোনের মাঝখানে তুলসী মঞ্চ। বাড়ির লাগোয়া দুটি প্রকাণ্ড কামিনী গাছ। একপাশে কুয়া আছে। হিন্দু বাড়িগুলো যেমন থাকে, ছবির মতো পরিচ্ছন্ন। উঠোনে দাঁড়াতেই মনে শান্তি-শান্তি একটা ভাব হল। আমি বললাম, এত চুপচাপ কেন? বাড়িতে লোকজন নেই?
না।
আপনি একা নাকি?
হুঁ।
বলেন কী। এক-একা এত বড় বাড়িতে থাকেন।
আগে অনেক লোকজন ছিল। কিছু মরে গেছে। কিছু চলে গেছে ইণ্ডিয়াতে। এখন আমি একাই আছি! আপনি স্নান করে ফেলুন।
স্নান-ফান লাগবে না। আপনি কিছু খাবারের ব্যবস্থা করুন, তাহলেই হবে।
একটু সময় লাগবে, রান্নার জোগাড় করতে হবে।
আপনি কি এখন রান্না করবেন?
রান্না না করলে খাবেন কী? বেশিক্ষণ লাগবে না।
ভদ্রলোক গামছা, সাবান এবং একটা জলচৌকি এনে কুয়ার পাশে রাখলেন।
স্নান করে ফেলুন। সারা দিন জার্নি করে এসেছেন, স্নান করলে ভালো লাগবে। কুয়ার জল খুব ভালো। দিন, আমি জল তুলে দিচ্ছি।
আপনাকে তুলতে হবে না। আপনি বরং রান্না শুরু করুন। খিদেয় চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে।
এই লুঙ্গিটা পরুন। ধোয়া আছে। আজ সকালেই সোডা দিয়ে ধুয়েছি। আমার আবার পরিষ্কার থাকার বাতিক আছে, নোংরা সহ্য করতে পারি না।
ভদ্রলোক যে নোংরা সহ্য করতে পারেন না, তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। তিনি রান্না করতে বসেছেন উঠোনে। উঠোনেই পরিষ্কার ঝকঝকে মাটির চুল। সুধাকান্তবাবু চুলার সামনে জলচৌকিতে বসেছেন। থালা, বাটি, হাঁড়ি সবই দেখি দু বার তিন বার করে ধুচ্ছেন।
সুধাকান্তবাবু।
বলুন।
আপনি বিয়ে করেন নি?
না।
চিরকুমার?
ঐ আর কি।
আপনি করেন কী?
শিক্ষকতা করি। হাই স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক। মনোহরদি হাই স্কুল।
রান্নাবান্না। আপনি নিজেই করেন?
হ্যাঁ, নিজেই করি। এক বেলা রান্না করি। এক বেলা ভাত খাই, আর সকালে চিড়া, ফলমূল-এ—সব খাই।
কাজের লোক রাখেন না কেন?
দরকার পড়ে না।
খালি বাড়ি পড়ে থাকে, চুরি হয় না?
না। চোর নেবে কী? আমি এক জন দরিদ্র মানুষ। আপনি স্নান করে নিন। স্নান করলে ভালো লাগবে।
অপরিচিত জায়গায় ঠাণ্ডার মধ্যে গায়ে পানি ঢালার আমার কোনোই ইচ্ছে ছিল কুৰুসুধাকান্তবাবু মনে হচ্ছে আমাকে না ভিজিয়ে ছাড়বেন না। লোকটি সম্ভবত শুচিবাইগ্রস্ত।
কুয়ার পানি নদীর পানির মতো গরম নয়, খুব ঠাণ্ডা। পানি গায়ে দিতেই গা জুড়িয়ে গেল। সারা দিনের ক্লান্তি, বিয়েবাড়ির উদ্বেগ, মৃত্যুসংক্রান্ত জটিলতা—সব ধুয়ে-মুছে গেল। চমৎকার লাগতে লাগল। তা ছাড়া পরিবেশটাও বেশ অদ্ভুত। পুরনো ধরনের একটা বাড়ি। ঝকঝকে উঠোনের শেষ প্রান্তে শ্যাওলা-ধরা কুয়া। আকাশে পরিষ্কার চাঁদ। কামিনী ফুলের গাছ থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি গন্ধ। এক ঋষির মতো চেহারার চিরকুমার বৃদ্ধ রান্না বসিয়েছেন। যেন বিভূতিভূষণের উপন্যাসের কোনো দৃশ্য।
সুধাকান্তবাবু?
বলুন!
রান্নার কত দুর?
দেরি হবে না।
এক-একা থাকতে আপনার খারাপ লাগে না?
না, অভ্যোস হয়ে গেছে।
বাসায় ফিরে আপনি করেন কী?
তেমন কিছু করি না। চুপচাপ বসে থাকি।
ভয় লাগে না?
সুধাকান্তবাবু এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না।
খাবার আয়োজন সামান্য, তবে এত চমৎকার রান্না আমি দীর্ঘদিন খাই নি। একটা কিসের যেন ভাজি, তাতে পাঁচফোড়নের গন্ধ-খেতে একটু টক-টক। বেগুন দিয়ে ডিমের তরকারি, তাতে ডালের বড়ি দেওয়া! ডালের বড়ি এর আগে আমি খাই নি! এমন একটা সুখাদ্য দেশে প্রচলিত আছে তা-ই আমার জানা ছিল না। মুগের ডাল! ডালে ঘি দেওয়াতে অপূর্ব গন্ধ।
আমি বললাম, সুধাকান্তবাবু, এত চমৎকার খাবার আমি আমার জীবনে খাই নি। দীর্ঘদিন মনে থাকবে।
সুধাকান্তবাবু বললেন, আপনি ক্ষুধার্ত ছিলেন, তাই এত ভালো লেগেছে। রুচির রহস্য ক্ষুধায়। যেখানে ক্ষুধা নেই, সেখানে রুচিও নেই।
আমি চুমৎকৃত হলাম।
লোকটির চেহারাই শুধু দার্শনিকের মতো না, কথাবার্তাও দর্শনঘেঁষা।
সুধাকান্তবাবু উঠোনে পাটি পেতে দিলেন। খাওয়াদাওয়ার পর সিগারেট হাতে সেখানে বসলাম। কিছুক্ষণ গল্পগুজব করা যেতে পারে। সুধাকান্তবাবুকে অবশ্যি খুব আলাপী লোক বলে মনে হচ্ছে না। এই যে দীর্ঘ সময় তাঁর সঙ্গে আছি, তিনি এর মধ্যে আমার নাম জানতে চান নি। আমি কী করি তাও জানতে চান নি। আমি এই মানুষটির প্রতি যথেষ্ট আগ্রহ বোধ করছি, কিন্তু এই লোকটা আমার প্রতি কোনো আগ্রহ বোধ করছে না। অথচ আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যারা মাষ্টারি করে, তারা কথা বলতে খুব পছন্দ করে। অকারণেই কথা বলে।
প্রায় মিনিট পনের আমরা চুপচাপ বসে থাকার পর সুধাকান্তবাবু আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, আপনি করছিলেন এক-একা আমি এই বাড়িতে থাকতে ভয় পাই কি না, তাই না?
আমি বললাম, হ্যাঁ, তাই।
সুধাকান্তবাবু বললেন, ভয় পাই। প্রায় রাতেই ঘুমুতে পারি না, জেগে থাকি। ঘরের ভেতর আগুন করে রাখি। হারিকেন জ্বালান থাকে। ওরা আগুন ভয় পায়। আগুন থাকলে কাছে আসে না।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কারা?
তিনি জবাব দিলেন না।
আমি বললাম, আপনি কি ভূতপ্রেতের কথা বলছেন?
হ্যাঁ।