কী যে বলেন মামা!
কথা যখন অক্ষরে-অক্ষরে ফলবে, তখন বুঝবি কী বলছি। কাপড়চোপড় খুলে ন্যাংটো করে সবাইকে ছেড়ে দেবে। পাড়ার লোক এনে ধোলাই দেবে। আমার কথা বিশ্বাস না-হয়, লিখে রাখি।
মামার কথা শেষ হবার সঙ্গে-সঙ্গেই খালিগায়ে নীল লুঙ্গি-পরা এক লোক প্লাষ্টিকের বালতিতে করে এক বালতি পানি এবং একটা মগা নিয়ে ঢুকল। পাথরের মতো মুখ করে বলল, হাত-মুখ ধোন। চা আইতাছে।
মামা বললেন, খবরদার কেউ চা মুখে দেবে না, খবরদার! দেখি ব্যাপার কী।
ভেতরবাড়ি থেকে কান্নার শব্দ আসছে। বিয়েবাড়িতে কান্না কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কিন্তু এই কান্না অস্বাভাবিক লাগছে। মধ্যবয়স্ক এক লোক এক বিশাল কেন্টলিতে করে চা নিয়ে ঢুকল!! আমি তাঁকে বললাম, ব্যাপার কী বলেন তো ভাই? সেই লোক বলল, কিছু না।
ভেতরবাড়ির কান্না এই সময় তীব্র হল। কান্না এবং মেয়েলি গলায় বিলাপ। কান্না যেমন হঠাৎ তুঙ্গে উঠেছিল, তেমনি হঠাৎই নেমে গেল। তার প্রায় সঙ্গে— সঙ্গেই মেয়ের বড়োচাচা ঢুকলেন। ভদ্রলোককে দেখেই মনে হল তাঁর ওপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেছে। তিনি নিচু গলায় যা বললেন, তা শুনে আমরা স্তম্ভিত। কী সর্বনাশের কথা! জানলাম যে কিছুক্ষণ আগেই তাঁর বড় ছেলে মারা গেছে। অনেক দিন থেকেই অসুখে ভুগছিল। আজ সকাল থেকে খুব বাড়াবাড়ি হল। সব এলোমেলো হয়ে গেছে এই কারণেই। তিনি তার জন্যে লজ্জিত, দুঃখিত ও অনুতপ্ত; তবে যত অসুবিধাই হোক–বিয়ে হবে। আজ রাতে সম্ভব হবে না, পরদিন।
এই কথা বলতে-বলতে তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
আমার মামা খুবই আবেগপ্রবণ মানুষ। অল্পতে রাগতেও পারেন, আবার সেই রাগ হিমশীতল পানিতে রূপান্তরিত হতেও সময় লাগে না। তিনি মেয়ের বড়চাচাকে জড়িয়ে ধরে নিজেও কেঁদে ফেললেন। কাতর গলায় বললেন, আপনি আমাদের নিয়ে মোটেও চিন্তা করবেন না। আমাদের কিছু লাগবে না, আপনি বাড়ির ভেতরে যান বেয়াই সাহেব।
অদ্ভুত একটা অবস্থা! এর চেয়ে যদি শুনতাম মেয়ে পালিয়ে গেছে, তাও ভালো ছিল। কারো ওপর রাগ ঢেলে ফেলা যেত।
আমরা বরযাত্রীরা খুবই বিব্রত বোধ করছি। স্থানীয় লোকজন এখন দেখতে পাচ্ছি। তারা বোধহয় এতক্ষণ ভেতরের বাড়িতে ছিলেন। আমরা বসার ঘরেই আছি। খিদেয় একেক জন প্রায় মরতে বসেছি। খাবার কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে কি না বুঝতে পারছি না। এই পরিস্থিতিতে খাবারের কথা জিজ্ঞেসও করা যায় না। একজন মামাকে কানেকানে এই ব্যাপারে বলতেই তিনি রাগী গলায় বললেন, তোমাদের কি মাথাটাথা খারাপ হয়েছে-এত বড় একটা শোকের ব্যাপার, আর তোমরা খাওয়ার চিন্তায় অস্থির! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! এক রাত না খেলে হয় কী? খবরদার, আমার সামনে কেউ খাবারের কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করবে না।
আমরা চুপ করে গেলাম। বার-তের বছরের ফুটফুটে একটি মেয়ে এসে পানিভর্তি একটা পানদান রেখে গেল। কাঁদতে-কাঁদতে মেয়েটি চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। এখনও কাঁদছে।
মামা মেয়েটিকে বললেন, লক্ষ্মী সোনা, তোমাদের মোটেই ব্যস্ত হতে হবে না। আমাদের কিছুই লাগবে না।
রাত আটটার দিকে থাকা এবং খাওয়ার সমস্যার একটা সমাধান হল! স্থানীয় লোকজন ঠিক করলেন, প্রত্যেকেই তাঁদের বাড়িতে একজন-দুজন করে গেষ্ট নিয়ে যাবেন। বিয়ে হবে পরদিন বিকেলে।
আমাকে যিনি নিয়ে চললেন, তাঁর নাম সুধাকান্ত ভৌমিক। ভদ্রলোকের বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে। বেঁটেখাটো মানুষ। শক্তসমর্থ চেহারা। এই বয়সেও দ্রুত হাঁটতে পারেন। ভদ্রলোক মৃদুভাষী। মাথার চুল ধবধবে সাদা। গেরুয়া রঙের একটা চাদর দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন বলেই কেমন যেন ঋষি-ঋষি লাগছে।
আমি বললাম, সুধাকান্তবাবু, আপনার বাসা কত দূর?
উনি বললেন, কাছেই।
গ্রাম এবং মফস্বলের লোকদের দূরত্ব সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। তাদের কাছেই আসলে দিল্লি হনুজ দূর অস্তের মতো। আমি হাঁটছি তো হাঁটছিই।
অনুগ্রহায়ণ মাস। গ্রামে এই সময়ে ভালো শীত থাকে। আমার গায়ে পাতলা একটা পাঞ্জাবি। শীত ভালোই লাগছে।
আমি আবার বললাম, ভাই, কত দূর?
কাছেই।
আমরা একটা নদীর কাছাকাছি এসে পড়লাম! আঁতকে উঠে বললাম, নদী পার হতে হবে নাকি?
পানি নেই, জুতো খুলে হাতে নিয়ে নিন।
রাগে আমার গা জ্বলে গেল। এই লোকের সঙ্গে আসাই উচিত হয় নি। আমি জুতো খুলে পায়জামা গুটিয়ে নিলাম। হেঁটে নদী পার হওয়ার কোনো আনন্দ থাকলেও থাকতে পারে। আমি কোনো আনন্দ পেলাম না, শুধু ভয় হচ্ছে কোনো গভীর খানাখন্দে পড়ে যাই কি না। তবে নদীর পানি বেশ গরম।
সুধাকান্তবাবু বললেন, আপনাকে কষ্ট দিলাম।
ভদ্রতা করে হলেও আমার বলা উচিত, না, কষ্ট কিসের তা বললাম না! নদী পার হয়ে পায়জামা নামাচ্ছি, সুধাকান্তবাবু বললেন, আপনি ছেলের কে হন?
ফুপাতো ভাই।
বিয়েটা না-হলে ভালো হয়। সকালে সবাইকে বুঝিয়ে বলবেন।
সে কী? মেয়েটার কারণে ছেলেটা মরল। এখন চট করে বিয়ে হওয়া ঠিক না। কিছুদিন যাওয়া উচিত।
কী বলছেন এ-সব!
ছেলেটা সকালবেল বিষ খেয়েছে। ধুতুরা বীজ। এই অঞ্চলে ধুতরা খুব হয়।
আপনি বলছেন কী ভাই?
ছেলের বাবা রাজি হলেই পারত। ছেলেটা বাঁচত। গোঁয়ারগোবিন্দ মানুষ। তার না মানেই না।
ছেলে-মেয়ের এই প্রেমের ব্যাপারটা সবাই জানে নাকি?
জানবে না কেন? মফস্বল শহরে এইসব চাপা থাকে না। আপনাদের শহরে অন্য কথা। আকছার হচ্ছে।