বাবার নাম, দাদার নাম, মার নাম। তাঁরা কে কেমন ছিলেন, কী করতেন। কে কীভাবে মারা গেলেন। দেশত্যাগ করলেন কবে। কেন করলেন। এত তথ্য ভদ্রলোক কীভাবে জোগাড় করলেন, কেনই-বা করলেন কে জানে!
দ্বিতীয় অধ্যায়টির নাম-সুধাকান্তবাবুও তাঁর বাগদত্তা। এই অধ্যায়টি বেশ ছোট। পড়ে মনে হল মিসির আলি তেমন কোনো তথ্য জোগাড় করতে পারেন নি।
তৃতীয় অধ্যায় সু র চরিত্র এবং মনমানসিকতা নিয়ে। শুরুটা এমন—
ভদ্রলোক নিজেকে সাধুশ্রেণীতে ফেলেছেন। শুরুতেই তিনি বলছেন যে, সাধুসন্ন্যাসীর জীবনযাত্রায় তাঁর আগ্রহ আছে। শ্মশানে-শ্মশানে ঘুরতেন, এবং স্থানীয় লোকজনও তাঁকে সাধুবাবা বলে। নিজের সাধু-চরিত্রটির প্রতি ভদ্রলোকের দুর্বলতা আছে। অন্যকে বলে না— আমি সাধু। ইনি তা বলছেন, কাজেই ধরে নেওয়া যাক ইনি আমাদের মতোই দোষগুণসম্পন্ন সাধারণ একজন মানুষ।
তিনি নিঃসঙ্গ জীবন ঠিক পছন্দ করেন বলেও মনে হল না। অনেক রাতে বাড়ি ফেরেন, যাতে এক-একা খুব অল্প সময় তাঁকে থাকতে হয়। এক জন সাধকশ্রেণীর মানুষের চরিত্রের সঙ্গেও ব্যাপারটা মিশ খায় না।–
মিসির আলির খাতা শেষ করতে-করতে রাত দুটো বেজে গেল। পরিশিষ্ট অংশে ভদ্রলোক ছটি প্রশ্ন তুলেছেন। এবং বলছেন-রহস্য উদ্ধারের জন্যে এই প্রশ্নগুলির জবাব জানা অত্যন্ত প্রয়োজন। এই ছটি প্রশ্ন পড়ে আমার মাথা ঘুরতে লাগল। এ কী কাণ্ড। মিসির আলি সাহেবের খাতা আবার গোড়া থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়লাম। ছটা প্রশ্নের কাছে এসে আবার চমকালাম। আমার মাথা ঘুরতে লাগল। ইচ্ছে করল এক্ষুণি ছুটে যাই মিসির আলির কাছে।
মিসির আলি সাহেব আজ অনেক সুস্থ
মিসির আলি সাহেব আজ অনেক সুস্থ। গায়ে চাদর জড়িয়ে বিছানায় বসে আছেন। হাতে শিবরাম চক্রবর্তীর বই জন্মদিনের উপহার। কিছুক্ষণ পড়ছেন, তারপর গা দুলিয়ে হাসছেন। আবার পড়ছেন, আবার হাসছেন।
আশেপাশের রুগীরা ব্যাপারটায় বেশ মজা পাচ্ছে। আগ্রহ এবং কৌতূহল নিয়ে তারা দেখছে এই বিচিত্র মানুষটাকে।
আমার দিকে চোখ পড়তেই মিসির আলি বললেন, শিবরামের বাঘের গল্পটা পড়েছেন? অসাধারণ! সকাল থেকে এখন পর্যন্ত এগার বার গল্পটা পড়লাম।
তাই নাকি?
আমার কী মনে হয় জানেন? হাসপাতালের রুগীদের জন্যে এই জাতীয় বই অষুধপত্রের সঙ্গে দেওয়া দরকার। প্রাণখুলে কয়েক বার হাসতে পারলে যে-কোনো অসুখ অনেকটা কমে যায় বলে আমার ধারণা।
আপনার তাহলে কমে গেছে?
জ্বি।
আমি বললাম, আপনার খাতাটা কাল রাতে পড়ে শেষ করেছি। আমার মনে হয়, যে-ছটি প্রশ্ন আপনি তুলেছেন, তার উত্তর জানা প্রয়োজন।
প্ৰয়োজন তো বটেই।
আমি আপনার সঙ্গে যাব এবং সুধাকান্তবাবুর সঙ্গে কথা বলব।
মিসির আলি হাসতে-হাসতে বললেন, আমি জানতাম আপনি এই কথা বলবেন।
আমি বললাম, কোনো- একটা ভৌতিক গল্প শুনলেই কি আপনি এ-রকম করেন, সব রহস্য উদ্ধারের জন্যে লেগে পড়েন?
মিসির আলি হাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।
আমি বললাম, আপনি কি আপনার শোনামতো ভৌতিক গল্পের রহস্য ভেদ করতে পেরেছেন?
না, পারিনি। শতকরা বিশ ভাগ ক্ষেত্রে কিছুই করতে পারিনি। আমার আরেকটা খাতা আছে। ঐ খাতার নাম রহস্য- খাতা! যে-সব সমস্যা আমি সমাধান করতে পারি নি, রহস্য- খাতায় সেইসব লিখে রেখেছি। আপনাকে একদিন পড়তে দেব।
ঠিক আছে। আপনার রহস্য-খাতা একদিন পড়ব!
কিংবা আপনি যদি চান তাহলে ঐখানকার একটা গল্প আপনাকে শোনাতেও পারি।
এইখানে বলবেন?
অসুবিধা কী? হাসপাতালে একটা ক্যান্টিন আছে। ক্যান্টিনে বসে চা খেতেখেতে গল্পটা আপনাকে বলতে পারি। আসলে ব্যাপারটা কি জানেন–আপনার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগছে। একটা গল্প যদি শুরু করি, তাহলে ভদ্রতার কারণেই আপনি গল্প শেষ না-করা পর্যন্ত বসে থাকবেন। এটাই হচ্ছে আমার লাভ।
আপনার শরীরের এই অবস্থায় আপনি ক্যান্টিনে যেতে পারবেন?
পারব। আমাকে যতটা কাহিল দেখাচ্ছে, ততটা কাহিল কিন্তু না। আসুন যাই।
আমরা ক্যান্টিনে বসলাম।
অবাক হয়ে লক্ষ করলাম হাসপাতাল নোংরা হলেও ক্যান্টিনাটা বেশ পরিষ্কার। ভিড় আছে, তবে হৈচৈ নেই। দু ধরনের চা পাওয়া যাচ্ছে-এক নম্বরী চা এবং দু নম্বৱী চা। এক নম্বরী চা এক টাকা করে, দু নম্বরটা তিন টাকা করে। মিসির বললেন, একই চা দু ধরনের কাপে দেওয়া হয় বলে দু ধরনের দাম। এবং মজার ব্যাপার কী জানেন, সবাই কিন্তু বেশি দামের চাটা খাচ্ছে। গতকালও চা খেতে এসেছিলাম। এক জনকে বলতে শুনলাম-এক নম্বরী চা মুখে দেওয়া যায় না। খানিকটা পানি গরম করে এনে দিয়ে দেয়।
আমি বললাম, আপনি কি নিশ্চিত যে দুটো চা-ই এক?
হ্যাঁ, নিশ্চিত প্রমাণ করে দিতে পারি। করব?
না, প্রমাণ করতে হবে না। আপনার কথা আমি বিশ্বাস করছি। এখন আপনার গল্পটা বলুন!
আপনার কি তাড়া আছে?
না, তাড়া নেই। তবু বেশিক্ষণ হাসপাতালে থাকতে আমার ভালো লাগে না।
মিসির আলি সঙ্গে-সঙ্গে গল্প শুরু করলেন—
রহস্য-খাতায় এই গল্পের নম্বর হচ্ছে একুশ। অর্থাৎ এটা একুশ নম্বর গল্প। এর চেয়ে অনেক ভয়ংকর গল্প আমার স্টকে আছে, তবু এটা বলছি, কারণ এটা বলতে গেলে একটা ফাস্ট্র-হ্যাণ্ড স্টোরি। আমার নিজের জীবনে ঘটে নি, তবে যার জীবনে ঘটেছে, সে আমার প্রিয় এক মানুষ। ঘটনাটার সঙ্গে আমার যোগাযোগও প্রত্যক্ষ।–
মেয়েটি হচ্ছে আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়া-আমার মার মামাতো বোনের মেয়ে। গ্রামের মেয়ে। হোষ্টেলে থেকে ময়মনসিংহ মমিনুন্নেসা কলেজে পড়ত। সেকেন্ড ইয়ারে উঠে। হঠাৎ করে তার বিয়ে হয়ে যায়। খুব বড় ঘরে বিয়ে হয়। ছেলের অর্থ, বিত্ত এবং প্রতিপত্তির কোনো অভাব নেই। পরিবারটিও এ-দেশের নাম-করা পরিবার। নাম বললেই আপনি চিনবেন, তাই নাম বলছি না। শুধু ধরে নিন যে, এই দেশের রাজনীতিতে এই পরিবারটির প্রত্যক্ষ যোগ আছে।