মজার ব্যাপার হচ্ছে, হাসপাতালেই নিতান্ত কাকতালীয়ভাবে মিসির আলির সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল। টেম্পোর সঙ্গে অ্যাকসিডেন্ট করে আমার এক কলিগ পা ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাঁকে দেখে ফিরে আসছি, হঠাৎ শুনি পিছন থেকে চিকন গলায় কে যেন আমাকে ডাকছে, হুমায়ূন সাহেব। এই যে হুমায়ূন সাহেব।
তাকিয়ে দেখি আমাদের মিসির আলি।
বিছানার সঙ্গে মিশে আছেন। গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না। চিচি আওয়াজ হচ্ছো! আমি বললাম, আপনার এ কী অবস্থা!
অসুখটা কাহিল করে ফেলেছে। গত কাল পর্যন্ত ধারণা ছিল মারা যাচ্ছি। আজ একটু ভালো।
ভালোর বুঝি এই নমুনা?
রক্ত পড়াটা বন্ধ হয়েছে। তবে ব্যথা সারে নি। ভাই, বসুন। আপনি আমাকে দেখতে এসেছেন, বড়ই আনন্দ হচ্ছে। আসছেন না দেখে ভাবছিলাম হয়তো চিঠি পান নি।
আমি খানিকটা লজ্জিত বোধ করতে লাগিলাম। একবার ইচ্ছা হল সত্যি কথাটা বলি। বলি যে, তাঁকে দেখতে আসি নি, ভাগ্যচক্ৰে দেখা হয়ে গেল। পরীক্ষণেই মনে হল, সব সত্যি কথা বলতে নেই।
হুমায়ূন সাহেব।
জ্বি।
বসুন ভাই, একটু বসুন।
আমি বসলাম। মিসির আলি বললেন, আপনাকে দেখে ভালো লাগছে। একটা বিশেষ কারণে মনটা খুব খারাপ ছিল।
বিশেষ কারণটা কী?
এগার নম্বর বেডটার দিকে তাকিয়ে দেখুন। আলসারের পেশেন্ট। কিছু খেতে পারে না। হাসপাতাল থেকে যে- খাবার দেয়, সবটাই রেখে দেয়। তখন কী হয় জানেন, তাঁর ছোটভাই সেটা খায়। খুব তৃপ্তি করে খায়। দিন-রাত বড় ভাইয়ের কাছে সে যে বসে থাকে, ঐ খাবারের আশাতেই বসে থাকে। আজ কী হয়েছে জানেন? বড়ভাইয়ের শরীর বোধহয় একটু ভালো হয়েছে, সে তার খাবার সব খেয়ে ফেলেছে। ছোট ভাইটা অভুক্ত অবস্থায় সারা দিন বসে আছে। অসম্ভব কষ্ট হয়েছে আমার, বুঝলেন। চোখে পানি এসে গিয়েছিল। আমাদের দেশের মানুষগুলো এত গরিব কেন বলুন তো ভাই?
আমি মিসির আলির প্রশ্নের জবাব দিতে পারলাম না। এগার নম্বর বেডের দিকে তাকলাম। ষোল-সতের বছরের এক জন যুবক অসুস্থ ভাইয়ের পাশে বসে আছে। আমি বললাম, ছেলেটি কি এখনো না-খেয়ে আছে?
হ্যাঁ। আমি নার্সের হাতে তার জন্যে পঞ্চাশটা টাকা পাঠিয়েছিলাম। সে রাখে নি। বড়ই কষ্ট হচ্ছে হুমায়ূন সাহেব!
আমি মিসির আলির হাত ধরলাম। এই প্রথম বুঝলাম-এই মানুষটি আমাদের আর দশটি মানুষের মতো ময়। এই রোগা আধপাগলা মানুষটির হৃদয়ে সমুদ্রের ভালবাসা সঞ্চিত আছে। এদের স্পর্শ করলেও পুণ্য হয়!
হুমায়ূন সাহেব।
জ্বি।
এই খাতাটা আপনি মনে করে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন।
কী খাতা?
সুধাকান্তবাবুর বিষয়ে এই খাতায় অনেক কিছু লিখে রেখেছি। বাসায় নিয়ে মন দিয়ে পড়বেন।
শরীরের এই অবস্থায়ও আপনি সুধাকান্তবাবুকে ভুলতে পারেন নি?
হাসপাতালে শুয়ে-শুয়ে এইটা নিয়েই শুধু ভাবতাম। কিছু করার ছিল না তো! অনেক নতুন-নতুন পয়েন্ট ভেবে বের করেছি। সব লিখে ফেলেছি।
ভালো করেছেন। এখন বিশ্রাম করুন। আমি খাতা নিয়ে যাচ্ছি। কাল আবার আসব।
মিসির আলি নিচু গলায় বললেন, এক বার কি চেষ্টা করে দেখবেন ঐ ছেলেটিকে বাইরে নিয়ে কিছু খাওয়ান যায় কি না?
আমি দেখব। আপনি এই নিয়ে ব্যস্ত হবেন না।
আমি ব্যস্ত হচ্ছি না।
চলে আসার আগে-আগে মিসির আলি বললেন, আপনি কষ্ট করে আমাকে দেখতে এসেছেন, আমি খুবই আনন্দিত।
আমি আবার লজ্জা পেলাম।
মিসির আলির খাতা নিয়ে বসা হল না
ব্যক্তিগত কাজ অনেক জমে ছিল, মিসির আলির খাতা নিয়ে বসা হল না। আমি তেমন উৎসাহও বোধ করছিলাম না। সামান্য গল্প নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ির আমি কোনো অর্থ দেখি না। আমি লক্ষ করেছি–গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি বেশির ভাগ মানুষ সম্পূর্ণ অবহেলা করে, মাতামতি করে তুচ্ছবিষয় নিয়ে। মিসির আলিও নিশ্চয় এই গোত্রের। পরিবারপরিজনহীন মানুষদের জন্যে এর অবশ্যি প্রয়োজন আছে। কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাক।–জীবন পার করে দেওয়া।
এক রাতে শোবার আগে খাতা নিয়ে বসলাম। পাতা উল্টে আমার আক্কেলগুড়ুম। এক শ ছিয়াশি পৃষ্ঠার ঠাসবুনোন লেখা। সুধাকান্তবাবু এবং তার গল্প নিয়ে যে এত কিছু লেখা যায় কে জানত। পরিষ্কার গোটা-গোটা লেখা। পড়তে খুব আরাম।
অবাক হয়ে লক্ষ করলাম। আমাকে নিয়ে তিনি আট পৃষ্ঠা লিখেছেন। সেই অংশটিই প্রথম পড়লাম। শুরুটা এ-রকম–
নাম : হুমায়ূন আহমেদ। বিবাহিত, তিনি কন্যার জনক। পেশা অধ্যাপনা।
বদমেজাজি। অহঙ্কারী। অধ্যাপকদের যেটা বড় ত্রুটি—অন্যদের বুদ্ধিমত্তা খাটো করে দেখা, ভদ্রলোকের তা আছে।
এই ভদ্রলোকের স্মৃতিশক্তি ভালো। তিনি গল্পটি দুবার আমাকে বলেছেন। দু বারই এমনভাবে বলেছেন যে, একটি শব্দ এদিক-ওদিক হয় নি। তাঁর কথাবার্তায় চিরকুমার সুধাকান্তবাবুর প্রতি গভীর মমতা টের পাওয়া যায়। এই মমতার উৎস কী?
সুধাকান্তবাবু এই ভদ্রলোককে ক্ষুধার্ত অবস্থায় চমৎকার কিছু খাবার রান্না করে খাইয়েছেন—এইটাই কি একমাত্র কারণ? আমার মনে হয়। সুধাকান্তবাবুর চেহারা, কথাবার্তাও ভদ্রলোকের ওপর খানিকটা প্রভাব ফেলেছে। সুধাকান্তবাবু অতি অল্প সময়ে এই বুদ্ধিমান মানুষটিকে প্রভাবিত করেছেন। কাজেই ধরে নেওয়া যায়, মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা সুধাকান্তবাবুর আছে। আমরা তাহলে কি ধারণা করতে পারি না, সুধাকান্তবাবু তাঁর আশেপাশের মানুষদেরও প্রভাবিত করেছেন?
সুধাকান্তবাবুকে নিয়ে তিনটি অধ্যায় আছে। প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম–পূর্বপরিচয়। এই অংশে সুধাকান্তবাবুর পরিবারের যাবতীয় বিবরণ আছে।