আমি বললাম, আপনাকে এত চিন্তিত মনে হচ্ছে কেন?
মিসির আলি বললেন, আমি আপনার কাছ থেকে গল্পটা আবার শুনতে চাই।
কেন?
প্লীজ, আরেক বার বলুন।
আবার কেন?
বলুন শুনি।
আমি দ্বিতীয় বার গল্পটা শুরু করলাম। এক জায়গায় মিসির আলি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, কত তারিখ বললেন?
বারই কার্তিক। এই তারিখে ঘটনাটা ঘটল।
বারই কাৰ্ত্তিক তারিখটা আপনার মনে আছে?
হ্যাঁ, আছে। প্রথম বার যখন আপনাকে গল্পটা বলি, তখনও তো বারই কাৰ্তিক বলেছিলাম বলে আমার মনে হয়।
হ্যাঁ, বলেছিলেন। আজও সেই একই তারিখ বলেন কি না। তাই দেখতে চেয়েছি। এই তারিখটা বেশ জরুরি।
জরুরি কেন?
বলছি কেন। তার আগে আপনি বলুন বার তারিখটা আপনার মনে রইল কেন? এসব দিন-তারিখ তো আমাদের মনে থাকে না।
বার তারিখ আমার বড়মেয়ের জন্মদিন। কাজেই সুধাকান্তবাবু বার তারিখ বলমাত্র আমার মনে গেঁথে গেল। তা ছাড়া আমার স্মৃতিশক্তি ভালো।
তাই তো দেখছি!
এখন বলুন তারিখটা এত জরুরি কেন?
যে-বছরে ঘটনাটা ঘটল, আমি সেই বছরের পঞ্জিকা দেখেছি। বার তারিখ হচ্ছে ২৪শে অক্টোবর। স্কুল ছুটি থাকে। ঐদিন লক্ষ্মীপূজার বন্ধ। কাজেই আপনার সুধাকান্তবাবু আপনাকে একটা মিথ্যা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ঐদিন স্কুল করেছেন।
হয়তো উনিই তারিখটা ভুল বলেছেন।
হ্যাঁ, তা হতে পারে। তবে আমি তাঁর নিজের মুখে ঘটনাটা শুনতে চাই।
আবার শুনতে চান?
হ্যাঁ।
কেন? ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছি না।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, বিশ্বাস করতে না চাইলে করবেন না। আপনাকে বিশ্বাস করতেই হবে এমন কোনো কথা আছে?
মিসির আলি বললেন, আপনি কি একটু যাবেন আমার সঙ্গে?
কোথায়?
ঐ জায়গায়?
কেন?
তাহলে জেনে আসতাম। তারিখটা বার কিনা।
আপনি কি পাগল নাকি ভাই?
মিসির আলি বললেন, ব্যাপারটা খুব জরুরি। আমাকে জানতেই হবে।
জানতে হলে আপনি যান। আমি আপনাকে ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি।
আপনি যাবেন না?
জ্বি-না। আজেবাজে ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামোনর সময় আমার নেই।
এটা আজেবাজে ব্যাপার না।
আমার কাছে আজেবাজে। আমার যাবার প্রশ্নই ওঠে না।
মিসির আলি মুখ কালো করে উঠে গেলেন। আমি মনে-মনে বললাম, ভালো পাগলের পাল্লায় পড়েছি। লোকটা মনে হল অ্যাবনর্ম্যাল। অ্যাবনর্ম্যাল সাইকোলজি করতে-করতে নিজেও ঐ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এরা দেখি বিপজ্জনক ব্যক্তি!
মিসির আলি যে কী পরিমাণ বিপজ্জনক ব্যক্তি তা টের পেলাম দিন দশেক পর। আমার ঠিকানায় মিসির আলির এক চিঠি এসে উপস্থিতি।
ভাই,
আপনি কেমনে আছেন?
আমি সুধাকান্তবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। দেখা হয় নি। উনি তাঁর দূর সম্পর্কের এক বোনের বাড়ি চলে গিয়েছেন বলে দেখা হয় নি। শুনলাম, তিনি সেখানে পুরো গরমের ছুটিটা কাটাবেন। যাই হোক, ওর অনুপস্থিতিতে আমি কিছু তথ্য সংগ্ৰহ করেছি। থানায় গিয়ে থানার রেকর্ডপত্র দেখেছি। ঐখানে ঘটনার তারিখ ২৩শে অক্টোবর দিবাগত রাত। অর্থাৎ ১১ই কার্তিক। কাজেই সুধাকান্তবাবু তারিখ বলায় একটু ভুল করেছেন বলে মনে হয়। আমি স্থানীয় স্কুলের হেডমাস্টার সাহেবের সঙ্গেও কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, ঐদিন সুধাকান্তবাবু ঠিকই সারা দিন ক্লাস করেছেন। কাজেই সুধাকান্তবাবু মিথ্যা বলেন নি। তারিখে ভুল করেছেন।
তারিখ ভুল করা খুব অস্বাভাবিক নয়। ভদ্রলোকের স্মৃতিশক্তি তেমন ভালো না। কারণ আপনার মুখেই শুনেছি দ্বিতীয় বার যখন তাঁর সঙ্গে আপনার দেখা হয়, তখন তিনি আপনাকে চিনতে পারেন নি।
থানার ওসি সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম।–পোষ্টমর্টেম করা হয়েছিল কি? উনি বললেন-পোস্টমর্টেমের মতো অবস্থা ছিল না। কুকুর সব ছিঁড়ে খুঁড়ে খেয়ে ফেলেছে। ছিন্নভিন্ন কিছু অংশ ছড়িয়ে ছিল। গ্রামের অন্যরাও তাই বলল।
মেয়েটি কোথাকার তাও জানা যায় নি। আমি এত দিন পর এ-সব খোঁজ করছি দেখে তারা প্ৰথমে একটু অবাক হলেও পরে আমাকে আগ্রহ করে সাহায্য করেছে, কারণ তাদের বলেছি আমার কাজই হচ্ছে রহস্যময় ঘটনা সংগ্ৰহ করা। গ্রামবাসীদের ধারণা, মেয়েটির অশরীরী আত্মা এখনো ঐ বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। নানান রকম শব্দ শোনা যায়। মেয়েলি কান্না, দরজা-জানালা আপনা-আপনি বন্ধ হওয়া-এইসব। আমি ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্যে দুরাত এই বাড়ির উঠোনে বসে ছিলাম। তেমন কিছু দেখি দি বা শুনি নি। তবে এক বার বাড়ির পিছনে মানুষ দৌড়ে যাবার শব্দ শুনেছি। এটা শেয়ালের দৌড়ে যাবার শব্দও হতে পারে। সারা জীবন শহরে মানুষ হয়েছি বলে এই জাতীয় শব্দের সঙ্গে আমার তেমন পরিচয় নেই।
আপনাকে চিঠিতে সব জানাচ্ছি, কারণ আমার শরীরটা খুবই খারাপ। ওখান থেকে এসেই প্রবল জ্বরে পড়ে যাই। এক বার রক্তবমি হয় বলে ভয় পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। এখন আছি মিডফোর্ড হাসপাতালে। ওয়ার্ড দু শ তেত্রিশ। বেড নাম্বার সতের। আপনি যদি আসেন তাহলে খুব খুশি হব। সুধাকান্তবাবু প্রসঙ্গে একটা জরুরি আলাপ ছিল। আশা করি আপনি ভালো আছেন।
আমি এই চিঠি ফেলে দিলাম। একটা পাগল লোককে শুরুতে খানিকটা প্রশ্ৰয় দিয়েছি বলে আফসোস হতে লাগল। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এই লোক আমার পিছনে জোঁকের মতো লেগে থাকবে এবং জীবনটা অস্থির করে তুলবে।
তাকে হাসপাতালে দেখতে যাবার পিছনেও কোনো যুক্তি খুঁজে পেলাম না। দেখতে যাওয়া মানে তাকে প্রশ্রয় দেওয়া। দূরে-দূরে থাকাই ভালো। দেখা হলে বলা যাবে-চিঠি পাই নি! বাংলাদেশে চিঠি না-পাওয়া এমন কিছু অবিশ্বাস্য ব্যাপার না! খুবই স্বাভাবিক।