দু-একটা পয়েন্ট লিখে রাখব। আমার স্মৃতিশক্তি ভালো, তবু মাঝে-মাঝে কিছু নোট রাখি। স্মৃতি মানুষকে প্রতারণা করে, লেখা করে না।
চা চলে এল। চা খোঁতে-খেতে ভদ্রলোক গল্প শুনলেন। তবে গল্প বলে আমি কোনো আরাম পেলাম না। ভদ্রলোক গল্পের মাঝখানে একবারও বললেন না।–অদ্ভুত তো। তারপর কী হল? কী আশ্চর্য!
তিনি পাথরের মতো মুখ করে গল্প শুনলেন এবং গল্প শেষ হওয়ামাত্র বললেন, আচ্ছা তাহলে যাই। আপনাকে কষ্ট দিলাম, কিছু মনে করবেন না।
আমি বললাম, আপনার কাজ হয়ে গেল?
জ্বি।
গল্পটা কি আপনার কাছে অদ্ভুত মনে হয় নি?
জ্বি-না, ভূতের গল্প সাধারণত এ-রকমই হয়। নতুনত্ব কিছু নেই। আমার শুধু একটা প্রশ্ন, মেয়েটার ডেডবডি কি শেষ পর্যন্ত ছিল?
তার মানে?
এ-জাতীয় গল্পে ডেডবডি শেষ পর্যন্ত থাকে না। বাতাসে মিলিয়ে যায় কিংবা কুকুর খেয়ে ফেলে। আপনি জানেন, কী হয়েছিল?
আমি জানি না, আমি জিজ্ঞেস করি নি। আপনি গল্পটার কিছুই বিশ্বাস করেন নি, তাই না?
জ্বি-না।
কেন, দয়া করে বলবেন কি?
এই জাতীয় ভয়াবহ অভিজ্ঞতা যখন হয়, তখন মানুষ খুব কনফিউজড অবস্থায় থাকে। কোনো ঘটনাই সে পরিষ্কার দেখে না। যা দেখে তাও সে গুছিয়ে বলতে পারে। না। অথচ আপনার সুধাকান্তবাবু চমৎকারভাবে সব বর্ণনা করলেন। অতি সূক্ষ্ম ডিটেলও বাদ দিলেন না। এই জিনিস পাওয়া যায় তৈরি-করা গল্পে।
আমি বললাম, সব মানুষ তো এক রকম নয়। কিছু-কিছু মানুষ বিপর্যয়ের সময়ও মাথা ঠাণ্ডা রাখে।
তা রাখে। যেমন আমি নিজেই রাখি।
তার পরেও আপনি বললেন এটা একটা গল্প?
জ্বি।
কেন বলুন তো?
সুধাকান্তবাবু আপনার কথামতো একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ, সাধু-প্রকৃতির লোক। এই ধরনের একজন মানুষ বিপদে ঈশ্বরের নাম নেবে, গায়ত্রী মন্ত্র পড়বে। একজন নাস্তিক পর্যন্ত যে-কাজটা করবে, তিনি করেন নি। ঘটনা সত্যি-সত্যি ঘটলে তিনি তা অবশ্যই করতেন! যেহেতু ঘটনাটা বানান, কাজেই এই গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা বাদ পড়েছে।
আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে রইলাম। লোকটার ওপর খানিকটা রাগ হচ্ছে। এককথায় সে বলে দিল গল্প বানান?
মিসির আলি বললেন, আপনার সঙ্গে যখন গল্প করছিলেন, তখন ভয় পেয়ে ভদ্রলোক মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন, অথচ ঐ রাতে করলেন না। ব্যাপারটা অদ্ভুত না?
আমি বললাম, সুধাকান্তবাবু শুধু-শুধু এ-রকম একটা গল্প বানাবেন কেন? এই রকম একটা গল্প তৈরির পিছনে কোনো একটা কারণ থাকবে নিশ্চয়ই!
তা তো থাকবেই। তাঁরও আছে।
কী কারণ?
অনেক কারণ হতে পারে। তবে আমার যা মনে হয, তা হচ্ছে উনি নিঃসঙ্গ ধরনের মানুষ, এই জাতীয় একটা গল্প তৈরি করে নিজে সবার আকর্ষণের কেন্দ্ৰবিন্দুতে চলে এসেছেন। এটা এক জন নিঃসঙ্গ মানুষের জন্যে কম কথা নয়।
মিসির আলি লোকটির প্রতি আমার ভক্তি হল। লজিক বা যুক্তি নামক ব্যাপারটা যে কত শক্তিশালী হতে পারে, মিসির আলি তা আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।
আমি বললাম, এই গল্পটা যে সত্যি, এটা আপনি কখন স্বীকার করবেন? অৰ্থাৎ কোন প্রমাণ উপস্থিত করলে আপনি গল্পটা মেনে নেবেন?
মিসির আলি হাসাতে-হাসতে বললেন, ঐ মেয়েটির ডেডবিড়ি যদি অন্যরা দেখে থাকে এবং কবর দেওয়া হয় বা দাহ করা হয়, তবেই আমি ঘটনাটা মেনে নেব।
আমি আপনাকে খবরটা এনে দেব। আমি চিঠি লিখে খবরটা জোগাড় করব। আপনি আপনার ঠিকানা লিখে রেখে যান।
মিসির আলি তাঁর ঠিকানা লিখে রেখে চলে গেলেন। আশ্চৰ্য্য কাণ্ড, আজও তাঁর পলিথিনের ব্যাগ ফেলে গেলেন। ব্যাগের ভেতর ছোট্ট একটা পাউরুটি, একটা কলা এবং এক টুকরো মাখন। গরমে সেই মাখন গলে ব্যাগময় ছড়িয়ে পড়েছে।
চিঠি লিখলাম
চিঠি লিখলাম আমার মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে যে-মেয়েটির বিয়ের কথা হয়েছিল, সেই মেয়ের বড়চাচাকে। আমার ধারণা ছিল ভদ্রলোক জবাব দেবেন না। যে-পরিচয়ের সূত্র ধরে চিঠি লিখেছি, সেই সূত্রে চিঠির জবাব দেওয়ার কথা নয়। ভদ্রলোক কিন্তু জবাব দিলেন। এবং বেশ গুছিয়েই জবাব দিলেন।
আপনার পত্র পাইয়াছি।
এক নিতান্ত দুর্ভাগ্যজনক অবস্থায় আপনাদের সহিত পরিচয় হইয়াছিল। আপনি যে সেই পরিচয় মনে রাখিয়া পত্ৰ দিয়াছেন তাহাতে কৃতজ্ঞ হইলাম। আপনি আমার ভাইস্তি প্রসঙ্গে জানিতে চাহিয়াছেন। দুই বৎসর আগে তাহার বিবাহ হইয়াছে। এই খবর তো আপনার জানা। সে এখন তাহার স্বামীর সহিত ইরাকে আছে। তাহার স্বামী একজন ডাক্তার। আপনাদের দোয়ায় তাহারা ভালোই আছে। দ্বিতীয় যে—বিষয়টি আপনি জানিতে চাহিয়াছেন, তাহার সবই সত্য। কুকুরের কামড়ে ছিন্নভিন্ন বালিকাটির দেহ আমরা সবাই দেখিয়াছি। তাহার মৃতদেহ সৎকারের কোনো ব্যবস্থা হয় নাই, কারণ বালিকাটি হিন্দু কি মুসলিম তাহা জানা সম্ভব হয় নাই।
ঘটনাটি সেই সময় জনমনে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করিয়াছিল। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার মফস্বল পাতায় খবরও ছাপা হইয়াছিল। অধিক আর কি? আমরা ভালো আছি। আপনার সর্বাঙ্গীণ কুশল কামনা করি।
আমি চিঠিটি ডাকযোগে মিসির আলির ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম। মনে-মনে হাসলাম। অভ্রান্ত যুক্তিও মাঝে-মাঝে অচল হয়ে যায়। এই চিঠিটি হচ্ছে তার প্রমাণ।
চিঠি পাঠাবার তৃতীয় দিনের মাথায় মিসির আলি এসে উপস্থিত। আমি হেসে বললাম, কি, গল্পটা এখন বিশ্বাস করলেন?
মিসির আলি শুকনো গলায় বললেন, হুঁ।
তাঁকে খুব চিন্তিত মনে হল।