ফাহমিদা কোনো কথা না বলে উদাস দৃষ্টিতে শামীর দিকে তাকিয়ে রইল।
তাই দেখে শামী বলল, কি হয়েছে বলছ না কেন? তোমার এই নীরবতা আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। এতদিন ডুব মেরেই বা ছিলে কেন? জান, আমি ফার্স্ট হয়েছি।
ফাহমিদা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, জানতাম, তুমি ফার্স্ট হবেই।
তুমিও তো ফাস্ট হয়েছ; তবু তুমি মন খারাপ করে রয়েছ কেন? এদিকে আমি প্রতিদিন পালেদের পুকুর পাড়ে তোমার অপেক্ষায় থেকেছি। আজও অনেকক্ষণ ছিলাম। চল তোমাকে মিষ্টি খাওয়াব। আমি ফার্স্ট হয়েছি, তুমি খুশী হওনি?
খুব খুশী হয়েছি। কিন্তু আজ তোমার সঙ্গে কোথাও যেতে পারব না।
কেন?
ফাহমিদা কিভাবে আব্বার কথাটা বলবে, চুপ করে ভাবতে লাগল।
কি হল চুপ করে রয়েছ কেন? আমরা দুজনেই ফাস্ট হয়েছি। আজ তো আনন্দের দিন। তোমার কোনো কথা শুনব না। চল, মিষ্টি খেয়ে সারাদিন দুজনে বেড়াতে বেড়াতে গল্প করে কাটাব।
বললাম না, আজ কোথাও যেতে পারব না?
কিন্তু কেন বলবে তো?
আমাদের দুজনের সম্পর্কের কথা আব্বা জানতে পেরেছে। জানার পর আমাকে ভীষণ রাগারাগি করেছে। আর যেন তোমার সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ না করি, সে কথা বলে বলেছে, যদি তার কথা না শুনি, তা হলে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে। আব্বার কথা এখন থাক। একটা কথা বলব, তোমাকে রাখতেই হবে। তুমি যদি সত্যিকার আমাকে ভালবেসে থাক, তা হলে তোমাকে একটা ওয়াদা করতে হবে।
শামী বলল, আমি তোমাকে সত্যিকার ভালবাসি কিনা তা আল্লাহপাক জানেন। আর তুমি যদি শুনতে চাও, তা হলে বলছি শুন, তোমাকে অনেক দিন থেকে নিজের প্রাণের চেয়ে বেশি ভালবাসি এবং চিরকাল বেসে যাব। আমার ভালবাসার মধ্যে মোহ বা স্বার্থ নেই। যদি আল্লাহ তোমার সঙ্গে আমার মিলন নাও করান, তবু তোমাকে মনে রেখে আমরণ কাটিয়ে দেব। অন্য কোনো মেয়েকে এ হৃদয়ে স্থান দিতে পারব না। তুমি আমার সমস্ত হৃদয় জুড়ে রয়েছ। সেখানে অন্য কারো স্থান নেই। এবার বল, কি ওয়াদা করতে হবে। প্রাণের বিনিময়েও তা আমি রক্ষা করব।
ফাহমিদা বলল, আমাদের মেলামেশা ফাইন্যাল পরীক্ষা পর্যন্ত বন্ধ রাখতে হবে। আমি যতদিন না তোমাকে দেখা করার কথা বলব ততদিন তুমি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। আমিও তোমাকে নিজের চেয়ে বেশি ভালবাসি। তোমার ক্ষতি হোক আমি তা চাই না। তোমার সুখ-শান্তি আমার কামনা।
বেশ, আমি ওয়াদা করলাম, তুমি যা বললে তা পালন করব। এবার আমি তোমাকে একটা অনুরোধ করব, রাখবে তো?
রাখব।
রফিকের হাতে মাঝে মাঝে চিঠি দিও।
তা একেবারেই অসম্ভব। কারণ শেষবারে যে চিঠিটা তুমি রফিকের হাতে দিয়েছিলে, সেটা আব্বার হাতে ধরা পড়েছে। তারপর কিভাবে ধরা পড়ল এবং সেই চিঠি পড়ে আব্বা কি করলেন তা সব বলে বলল, এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছ, কেন এতদিন তোমার সাথে যোগাযোগ করিনি এবং আমার চেহারা এত মলিন কেন আর সেই জন্যেই জোবেদাদের বাড়িতে যেদিন তুমি তার হাতে ডেকে পাঠিয়েছিলে সেদিন আসতে পারি নি।
শামী বলল, ঠিক আছে, আর বেশি কিছু তোমাকে বলতে হবে না। তুমি খবর না দেয়া পর্যন্ত যোগাযোগ করব না। তারপর ভিজে গলায় বলল, একটা কথা মনে রেখ, তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি সারাজীবন অপেক্ষা করব। এখন আসি তা হলে বলে সালাম বিনিময় করে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল।
ফাহমিদা তার দিকে তাকিয়ে রইল। শামী যখন স্কুলের গেটের বাইরে চলে গেল। তখন গুটি গুটি পায়ে সেও গেটের দিকে এগোল।
রাহেলা, জোবেদাও টেস্টে এলাউ হয়েছে। তারা ফাহমিদাকে খুঁজতে গিয়ে তাকে। শামী ভাইয়ের সাথে কথা বলতে দেখে গেটের বাইরে এসে অপেক্ষা করছিল। ফাহমিদা এলে রাহেলা বলল, কিরে, শামী ভাইকে একা ছেড়ে দিলি যে? সে ফার্স্ট হয়েছে শুনে মিষ্টি খাওয়াতে বললাম। শামী ভাই অন্যদিন খাওয়াবে বলে চলে গেলেন। তার মন খুব খারাপ দেখলাম। এখন দেখছি তোরও মন খারাপ। কি ব্যাপার বলতো?
ফাহমিদা বলল, আমাদের ব্যাপারটা আব্বা জেনে গিয়ে আমার উপর যে ভীষণ রাগারাগি করেছে তা তোদেরকে একদিন বলেছিলাম। আজ শামীকে সেকথা জানিয়ে বললাম, এখন কিছুদিন যেন সে আমার সাথে যোগাযোগ না করে।
জোবেদা বলল, শামী ভাই কি বললেন?
ফাহমিদা বলল, কি আর বলবে? সেও তাই বলল। এবার এসব কথা থাক, চল, বাড়ি যাই চল।
শামী ফাহমিদাদের স্কুল থেকে বেরিয়ে এসে ফেরার পথে বন্ধু রায়হানের কাছে গেল।
রায়হান তাকে দেখে সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, তোদের আজ টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবার কথা না? তোর মুখ অত মলিন কেন? রেজাল্ট কি ভালো হয়নি?
শামী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, পরীক্ষার রেজাল্ট আল্লাহর রহমতে ভালো হয়েছে। তারপর ফাহমিদা যা বলেছে ও তার ওয়াদা করার কথা বলল।
কিছুদিন আগে রায়হান তার প্রাইভেট মাস্টারের কাছে ফাহমিদার বিয়ের কথা শুনেছে। ফাহমিদার ছোট খালা খালু এসে বৌ করবে বলে কথাবার্তা পাকা করে গেছেন। ওনাদের ছেলের নাম মালেক। সে আমেরিকায় চাকরি করে। দেশে এলেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন হবে। রায়হান যে মাস্টারের কাছে প্রাইভেট পড়ে, ফাহমিদাও সেই মাস্টারের কাছে প্রাইভেট পড়ে। ফাহমিদাকে পড়াতে গিয়ে তিনি একদিন আবসার উদ্দিনের কাছে শুনেছিলেন। সে কথা শোনার পর রায়হান চিন্তা করেছে, কথাটা শামীকে জানাবে কিনা। তার এক মন বলল, জানান উচিত। আবার এক মন বলল, শামী শুনে খুব দুঃখ পাবে। তার চেয়ে সে নিজে একদিন না একদিন জানতে পারবে। এসব কথা তো আর গোপন থাকে না। তা ছাড়া ফাহমিদাও যখন ব্যাপারটা জানে তখন সেও হয়তো শামীকে জানাতে পারে। আগে বেড়ে কথাটা না বলাই ভালো। আমার কাছে শুনে যদি শামী ভাবে, আমি তার দুষমণি করছি। এইসব ভেবে রায়হান শামীকে জানায় নি।