আবসার উদ্দিন ততক্ষণ বইটা নিয়ে বইয়ের উপর শামীর নাম ঠিকানা লেখা দেখে কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। এক সময় বইটার পাতা উল্টাতে গিয়ে শামীর দেয়া চিঠি পেয়ে গেলেন। চিঠি পড়ে মাথা গরম হয়ে গেল। হুংকার দিয়ে মেয়েকে ডাক দিলেন।
ফাহমিদা নিজের রুমে বসে বসে রফিকের জন্যে অপেক্ষা করছিল। আব্বার হুংকার শুনে ভয় পেয়ে গেল। কারণ তার আব্বা তাকে কখনও কড়া মেজাজে কথা বলে নি। রুম থেকে বেরিয়ে আব্বার হাতে বই ও চিঠি দেখে এবং রফিককে সেখানে দেখে আরো ভয় পেল। চিন্তা করল, চিঠি পড়ে আব্বা নিশ্চয় সবকিছু জেনে ফেলেছে।
তাকে দেখে আবসার উদ্দিন চিঠিটা কুচিকুচি করে ছিঁড়ে দুহাতে দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গম্ভীরস্বরে বললেন, শামীকে তুই এভাবে মন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দে। তুই এখন ছেলে মানুষ। প্রেম ভালবাসার কি বুঝিস? শামী খুব খারাপ ছেলে। তা ছাড়া তার বাবা গরীব। তার উপর মোল্লা। মোল্লাকী করে কোনো রকমে সংসার চালায়। তাদের কি আছে? না আছে টাকা পয়সা, না আছে বংশ মর্যাদা। যেভাবে তুই মানুষ হচ্ছিস, তাতে করে ওদের বাড়িতে গিয়ে সারাজীবন দুঃখে ভাসবি। একদণ্ড সুখে থাকতে পারবি না। আমাদের বংশের এটা সম্মান আছে। এসব কথা লোকে শুনলে, সেই সম্মান ধূলোয় মিশে যাবে। আমি তোর বাবা। প্রত্যেক বাবা তার সন্তানের মঙ্গল কামনা করে। আমার শেষ কথা শুনে রাখ, এরপরও যদি তুই শামীর সাথে যোগাযোগ রাখিস, তা হলে জ্যান্ত কবর দিয়ে দেব। যা, এবার মন দিয়ে পড়াশোনা কর। সামনে তোর পরীক্ষা।
ফাহমিদা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। সেইভাবে নিজের রুমে চলে গেল। তারপর থেকে সে আর শামীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে সাহস করল না।
ফাহমিদা যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে শামী খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। প্রিটেস্ট পরীক্ষার মাস খানেক পর থাকতে না পেরে একদিন জোবেদাদের বাড়ি গেল।
জোবেদা তাকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, আরে শামী ভাই যে, আসুন বসুন।
শামী সালামের উত্তর দিয়ে বলল, তুমি আমার এটা উপকার করবে?
জোবেদা বলল, একটা কেন হাজারটা করব। দরকার হলে প্রাণও বাজী রাখব। আপাততঃ দুমিনিট অপেক্ষা করুন আসছি বলে সেখান থেকে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে একহাতে একটা প্লেটে দুটো সিদ্ধ ডিম ও এক কাপ চা আর অন্য হাতে এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে টেবিলের উপর রেখে বলল, প্রথমে এগুলোর সদ্ব্যবহার করুন তারপর কি করতে হবে শুনবো।
শামী বলল, তুমি এসব করতে গেলে কেন? আমি কি মেহমান নাকি?
জোবেদা একটা ছোট দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যদি বলি আপনি তার চেয়েও অনেক বেশি। তারপর হেসে উঠে বলল, তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলুন; নচেৎ আপনার কোনো উপকার করতে পারব না।
শামী জোবেদার কথার মধ্যে যেন অন্য সূর রয়েছে বুঝতে পারল। কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্য। তখন তার মন ফাহমিদাকে দেখার জন্য উতলা হয়ে আছে। তাই একটা ডিম খেয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ফাহমিদাকে একটু ডেকে আনতে পার?
জোবেদা বলল, কেন পারব না। আপনি চা খাওয়া শেষ করুন, আমি ততক্ষণে ওকে ডেকে নিয়ে আসছি। তারপর সে বেরিয়ে গেল।
তাদের বাড়ি থেকে অল্প কিছু দূরে ফাহমিদাদের বাড়ি। ফাহমিদা ঘরে ছিল, জোবেদাকে দেখে বলল, কিরে, হঠাৎ কি মনে করে?
জোবেদা বলল, শামী ভাই আমাদের সদরে বসে আছেন। তোকে ডাকছেন।
ফাহমিদা বলল, আব্বা ঘরে আছে, এখন যেতে পারব না। তুই শামী ভাইকে বলবি, সে যেন এদিকে না আসে। আমি পরে তার সাথে যোগাযোগ করব।
জোবেদা বলল, মনে হচ্ছে, শামী ভাইয়ের সঙ্গে তোর অনেক দিন দেখা সাক্ষাৎ হয়নি, তাই এসেছে। তোর আব্বা আছে তো কি হয়েছে? সে তো আর জানবে না, তুই শামী ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিস?
ফাহমিদা একটু চিন্তা করে বলল, তোকে সব কথা এখন বলা যাবে না। শামী ভাইকে যা বলতে বললাম গিয়ে তাই বল।
জোবেদা মুখ ভার করে ফিরে এসে ফাহমিদা যা বলেছে বলল।
শুনে শামীর মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, কি আর করা যাবে, চলি তা হলে। তারপর সালাম বিনিময় করে ফিরে এল।
দেখতে দেখতে টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেল। আজ রেজাল্ট দেবে। শামী পালেদের পুকুর পাড়ে এসে অনেকক্ষণ ফাহমিদার জন্য অপেক্ষা করল। কিন্তু ফাহমিদা এল না। ভাবল, সে হয়তো আমি আসবার আগে স্কুলে চলে গেছে। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে স্কুলে রওয়ানা দিল। স্কুলে পৌঁছে রেজাল্ট দেখার জন্য নোটিস বোর্ডের কাছে এগিয়ে যেতে চার পাঁচজন সহপাঠি তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, শামী ভাই, তুমি ফার্স্ট হয়েছ।
শামী শোকর আলহামদুলিল্লাহ বলে বলল, তোমরাও নিশ্চয় এলাউ হয়েছ? তারা সবাই বলে উঠল, হ্যাঁ শামী ভাই আল্লাহর রহমতে আমরাও এলাউ হয়েছি।
শামী তবু নোটিস বোর্ডের কাছে গিয়ে এক নাম্বারে তার নাম দেখে ভীষণ আনন্দ অনুভব করল। তারপর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মেয়েদের স্কুলে গেল।
ছেলেদের স্কুল থেকে মেয়েদের স্কুল পাঁচ-ছ মিনিটের পথ। শামী এসে ফাহমিদাকে খুঁজতে লাগল। নোটিস বোর্ডের কাছে না পেয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বারান্দার শেষ মাথায় তাকে একাকি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। শামী নোটিশ বোর্ডে দেখল, ফাহমিদাও ফাস্ট হয়েছে। তবুও তাকে একাকি মন ভার করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, তুমি এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন? তোমার চেহারাই বা এত মলিন কেন? আজ তোমাকে এরকম দেখব স্বপ্নেও ভাবিনি।