ইতি
ফাহমিদা
[বিঃ দ্রঃ উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।
পরের দিন তিন বান্ধবী স্কুলে যাওয়ার পথে জোবেদা ফাহমিদাকে জিজ্ঞেস করল, কিরে, চিঠি লিখেছিস?
ফাহমিদা অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হ্যাঁ, লিখেছি।
জোবেদা বলল, কই, জলদি বের কর।
ফাহমিদা একটা বইয়ের ভিতর থেকে মুখ খোলা রঙ্গিন খাম বের করল।
জোবেদার আগে রাহেলা ছোঁ মেরে তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বলল, আমি পড়ছি। সে জোরে জোরে চিঠিটা পড়ে ভাজ করে খামের ভিতর পুরে ফাহমিদার হাতে ফেরৎ দেওয়ার সময় বলল, কি, আমাদের কথা ঠিক হল? অনেক দিন থেকে তা হলে ডুবে ডুবে পানি খাওয়া হচ্ছে? আমরা বাজীতে জিতবই।
ফাহমিদা বলল, বাজী তো আমাকে নিয়ে হয়নি, শামীকে নিয়ে হয়েছে। চিঠির উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত বাজীর ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। আর এতে ডুবে ডুবে পানি খাওয়ার কি হল? একজনের দ্বারা তো তা সম্ভব নয়।
জোবেদা বলল, আজ চিঠিটা দে। কাল নিশ্চয় ফলাফল পাওয়া যাবে। তখন বোঝা যাবে, ডুবে ডুবে পানি খাচ্ছ কিনা। কিরে, চিঠিটা তুই দিবি? না আমরা কেউ দেব?
ফাহমিদা বলার আগে রাহেলা বলে উঠল, আমরা কেউ দিতে যাব কেন? যারটা তারই দেয়া ভালো।
ফাহমিদা চুপ করে রইল।
জোবেদা বলল, তুই ঠিক কথা বলেছিস। তারপর তারা যুক্তি করে ঠিক করল, ছুটির পর শামীর জন্য সবাই মিলে রাস্তায় অপেক্ষা করবে। তাকে আসতে দেখলে রাহেলা ও জোবেদা লুকিয়ে পড়বে। ফাহমিদা চিঠি দেয়ার পর তারা তাদের কাছে আসবে।
সেদিন ছুটির পরে ফেরার পথে রাস্তার ধারে পালেদের বড় পুকুরের পাড়ে বসে তারা অপেক্ষা করতে লাগল।
শামী ছুটির পর প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফিরছিল। পালেদের পুকুরের কাছে এসে ফাহমিদাকে একাকি একটা পেয়ারা গাছতলায় বসে থাকতে দেখে সালাম দিয়ে আতংকিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? এখানে বসে আছেন কেন?
ফাহমিদা সালামের উত্তর দিয়ে হাসিমুখে বলল, না, শরীর খারাপ লাগছে না। আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। আসুন কিছুক্ষণ আলাপ করি।
শামী তার কথা শুনে আনন্দিত হয়ে ফাহমিদার পাশে বসে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ফাহমিদাও শামীর মুখের দিতে তাকিয়ে রইল। কতক্ষণ যে তারা ঐভাবে ছিল তা জানতে পারল না। এক সময় ফাহমিদা দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, এতক্ষণ ধরে কি। দেখছেন?
শামী বাস্তবে ছিল না, ফাহমিদার কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, আপনাকে।
ফাহমিদা লজ্জারাঙ্গা হয়ে বলল, আগেও তো দেখেছেন?
এত কাছ থেকে এভাবে কোনো দিন দেখিনি। এবার বলুন, অপেক্ষা করছিলেন কেন?
আপনি আমাকে আপনি করে বলছেন কেন? আমি তো আপনার চেয়ে ছোট। তা ছাড়া আমরা তো একই গ্রামের ছেলেমেয়ে।
তাই যদি বলেন, তা হলে আপনিও কেন আমাকে আপনি করে বলছেন?
আপনি আমার থেকে বড়। বড়কে আপনি করে বলাই তো উচিত।
তা অবশ্য উচিত। তবে সবক্ষেত্রে নয়। এবার থেকে আমরা কেউ কাউকে আপনি করে আর বলব না, কেমন?
ফাহমিদা মাথা নিচু করে বলল, তাই হবে।
শামী বলল, কেন অপেক্ষা করছিলে বলবে না?
ফাহমিদা চিঠিটা তার হাতে দিয়ে বলল, এই জন্যে।
শামী চিঠি নেয়ার সময় তার হাত ধরে রেখে বলল, এটাতে কি আছে জানি না। তবু বলছি, এটার জন্য বহুদিন থেকে অপেক্ষা করছিলাম। আল্লাহপাক সেই আশা আজ পূরণ করলেন। সেজন্যে তাঁর পাকদরবারে জানাই হাজার হাজার শুকরিয়া। শামী ফাহমিদার হাত ধরে রাখতে সে কাঁপছে বুঝতে পেরে শামী তার হাত ছেড়ে দিল।
শামীকে আসতে দেখে রাহেলা ও জোবেদা অনতিদূরে একটা বড় আমগাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিল। তারা এতক্ষণ তাদের ক্রিয়াকলাপ দেখছিল ও শুনছিল। এবার তারা এগিয়ে এসে একসঙ্গে শামীকে সালাম দিল।
শামী একটু ঘাবড়ে গিয়ে সালামের উত্তর দিয়ে আমতা আমতা করে বলল, তোমরা এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
রাহেলা হাত বাড়িয়ে আম গাছটা দেখিয়ে বলল, ওটার আড়ালে।
জোবেদা বলল, শামী ভাই, আমরা কিন্তু আপনাদের সব কথা শুনেছি। কিছু মাইণ্ড করেন নি তো?
তাদের কথা শুনে শামীর ভয় কেটে গেল। বুঝতে পারল, ফাহমিদা যে আমাকে চিঠি দেবে তা তারা জানে। বলল, মাইণ্ড করার কি আছে। চল, এবার এক সঙ্গে যাওয়া যাক।
জোবেদা বলল, আপনি যান, আমরা একটু পরে আসছি।
ঠিক আছে তাই এস বলে শামী তাদের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে চলে গেল।
শামী চলে যাওয়ার পর রাহেলা ফাহমিদাকে বলল, কিরে শামী ভাইকে কেমন বুঝলি? তোদের কথাবার্তা শুনে তো মনে হল দুজনেই ফেঁসে গেছিস?
ফাহমিদা লজ্জা পেয়ে বলল, হয়তো তোদের কথা ঠিক। তবে চিঠির উত্তর পেলে সিওর হওয়া যাবে। এখন চল বাড়ি যাই।
শামী বাড়িতে এসে বই খাতা রেখে ফাহমিদার চিঠিটা পড়ে উত্তর লিখতে বসল।
প্রিয়তমা,
প্রথমে আমার আন্তরিক ভালবাসা নিয়ে আমাকে ধন্য করো। পরে জানাই যে, পত্র পড়ে আমি যে কত আনন্দিত হয়েছি, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। চাতক পাখিরা তৃষ্ণার্ত হয়ে এক ফোঁটা বৃষ্টির আশায় যেমন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে তেমনি আমিও অনেক দিন থেকে তোমার চিঠির আশায় অপেক্ষা করছিলাম। মরুদ্যানে পথিকরা বিশ্রাম নেয়ার সময় বৃষ্টি হলে তারা যেমন তৃপ্ত হয়, তোমার চিঠি পেয়ে আমিও সেইরূপ তৃপ্তি পেলাম। কিশোর বয়সে তোমাকে দেখে আমিও এক রকমের আনন্দ পেতাম। তারপর যত বড় হয়েছি, তোমাকে দেখে আরো বেশি আনন্দ পেয়েছি। যখন শয়তানের প্ররোচনায় পড়াশোনা ছেড়ে দিই তখন একদিন রাহেলা ও জোবেদার সঙ্গে তোমাকে স্কুলে যেতে দেখে সেই পুরোনো আনন্দ আবার মনের মধ্যে অনুভব করি। সেই দিন থেকে আমার মন আমাকে বলতে লাগল, তুমি যে ফাহমিদাকে দেখে এত আনন্দ পাও, তার কারণ চিন্তা করে দেখছ? তার কারণ হল, তুমি তাকে ভালবাস। তাকে পেতে হলে তোমাকে লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হতে হবে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, স্কুলে লেখাপড়া করব। তারপর আব্বা-আম্মাকে রাজি করিয়ে স্কুলে ভর্তি হলাম। স্কুলে ভর্তি হওয়ার প্রায় দেড় বছর পর এক বর্ষার দিনে আল্লাহপাক তোমার সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ করে দিয়ে আমাকে ধন্য করলেন। সেই থেকে তোমার কাছ থেকে এই রকম একটা চিঠি পাওয়ার আশা করছিলাম। সেই আশাও আল্লাহপাক পূরণ করলেন। সেজন্য তাঁর পাক দরবারে জানাচ্ছি লাখো শুকরিয়া। ফাহমিদা তোমাকে আমি আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে ভালবাসি। সেই ভালবাসা আমাকে পড়াশোনা করে মানুষ হওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছে। মাঝে মাঝে পত্র দিয়ে এবং দেখা দিয়ে সুখী করো। তোমাকে একান্ত করে পাওয়াই আমার জীবনের একমাত্র কামনা। তবে আমাকে উপযুক্ত হওয়া পর্যন্ত তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। পারবে না ফাহমিদা অপেক্ষা করতে? আমার মন বলছে পারবে। অনেক কিছু লিখতে মন চাচ্ছে; কিন্তু তোমার পত্র পেয়ে মনের মধ্যে আনন্দের স্রোত এত বেশি বইছে যে, সেগুলো তৃণখণ্ডের মতো ভেসে যাচ্ছে। এই পত্রের উত্তর পাওয়ার পর সেইসব কথা লিখব। এখন আল্লাহপাকের কাছে তোমার সহি সালামতের জন্য দোয়া করে শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।